সর্বশেষ ব্রিফিংয়ে যা বলল সেনাবাহিনী
সিলেটের সুরমা উপজেলার শিববাড়ি এলাকায় ‘জঙ্গি আস্তানা’ ‘আতিয়া মহল’ গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ৩টা থেকে ঘিরে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর পর শনিবার সকাল থেকে সেখানে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ পরিচালিত হচ্ছে।
অভিযান নিয়ে আজ রোববার বিকেল সাড়ে ৫টার কিছু পরে শিববাড়ি এলাকার পাঠানপাড়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সামনে ব্রিফিং করেন সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান।
অভিযান সম্পর্কে আজ দ্বিতীয় দিনের মতো সেনাবাহিনী ব্রিফ করে। এর আগে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায়ও ব্রিফ করেছিল সেনাবাহিনী। শনিবার সকাল থেকেই সেনাবাহিনী ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ পরিচালনা করছে।
আজকের ব্রিফিংয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসানের পুরো বক্তব্যই এখানে তুলে ধরা হলো-
“ভেতরে যে কয়জন জঙ্গি আছে বা ছিল, যতটুকু আমরা বুঝতে পেরেছি বেশ ওয়েল ট্রেইনড। তার দু-একটা এক্সাম্পল বলি, যেমন আমরা যখন ক্লিয়ারেন্সের পর্যায়ে ভেতরে গ্রেনেড লপ করেছি সেই গ্রেনেড ধরে আবার উল্টা তারা আমাদের দিকে বাইরে নিক্ষেপ করেছে। যখন টিয়ারসেল নিক্ষেপ করেছি, টিয়ারসেল থেকে বাঁচার জন্য আগুন জ্বালাইতে হয়, এই টেকনিকগুলো তারা মোটামুটি বেশ অভ্যস্ত।
পুরো ঘরের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় যেভাবে আইইডি ফিক্স করেছে তাতে যতটুকু ধারণা করা যাচ্ছে যে, জঙ্গি যারা আছে বেশ ভালো জ্ঞান রাখে কীভাবে একটা টার্গেটকে দুর্গম করে তুলতে হয়। যার দরুন অপারেশনটা শেষ করতে বেশ ভালো ঝুঁকি আছে এবং সময় লাগছে। এই ঝুঁকির মধ্যে যে গতকালকে ৭৮ জন বাসিন্দাই ভবনটার মধ্যে ছিল তাদেরকে যে নিরাপদে বের করা গেছে এটা একটা বিশেষ আল্লাহর রহমত।
আমাদের কমান্ডোরা একটা ভালো টেকনিক যেটা তারা অ্যাপ্লাই করেছিল যে আইইডি যেগুলো লাগিয়েছে মোস্টলি গ্রাউন্ড ফ্লোরে, নিচে যে সিঁড়ি বা ঢোকার যে পথ বা যে অ্যাপ্রোচটা আছে সেদিকে বেশির ভাগ আইইডি লাগাইছে। সেজন্য কমান্ডোরা নিচের দিকে অ্যাপ্রোচ না করে উপর থেকে পাশের বিল্ডিং থেকে যেয়ে মই লাগিয়ে উপর থেকে নেমেছে। একটা একটা করে যখন তারা পাঁচতলায় গিয়েছে, চারতলায় গিয়ে তারা ব্লক করেছে পাঁচতলার যারা বাসিন্দা ছিল তাদের আউট করেছে।
এ রকম করে করে দোতলা পর্যন্ত তারা করেছে। আর নিচতলার জন্য তখন তো আগের থেকে আমরা দেখতে পেরেছিলাম যে ভেতরে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ আইইডি লাগানো আছে। সেখানে তখন আর নিচে না যেয়ে বাইরে থেকে গ্রিল কেটে হোল তৈরি করে ভেতর থেকে লোকগুলোকে বের করা হয়েছে।
যার দরুন আমার মনে হয় যে জঙ্গিরা এই অবস্থাটা ফেস করার জন্য খুব একটা প্রস্তুত ছিল না। এ ছাড়া সময় যেটা নেওয়া হয়েছিল যে ওই সময় বৃষ্টি হচ্ছিল, ঝড় হচ্ছিল ওয়েদারটাও খুব ফেভারেবল ছিল। এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে খুব একটা সাড়াশব্দ হয়নি, টের পায়নি। যার দরুন তাদেরকে বের করে নিয়ে আসা হয়েছে। কালকের থেকে তারপরে আমরা জঙ্গিদেরকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য চেষ্টা করছিলাম, আজকে সকাল থেকে আসার পর থেকে বিভিন্ন টেকনিক অ্যাপ্লাই করছিলাম প্রথমে আমাদের রকেট লঞ্চারের মাধ্যমে বড় হোল তৈরি করে, এরপরে এক্সপ্লোসিভ ব্যবহার করে খুব একটা সুবিধা হচ্ছিল না। এরপর যখন আমরা টিয়ারসেল নিক্ষেপ করেছি তারপরের থেকে জঙ্গিরা ভেতরে থাকা তাদের জন্য ডিফিকাল্ট ছিল। তখন তারা দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে। তখন আমরা নিশ্চিত দুজনকে ইফেক্টিভলি এঙ্গেজ করতে পেরেছি এবং দুজন জঙ্গির নিশ্চিত মৃত্যু হয়েছে।
একজন ওই সময়ই তাঁর যে সুইসাইডাল ভেস্ট সবার মধ্যে লাগানো ছিল সেটা এক্সপ্লোট করেছে। বাকিদের মধ্যে এখনো আমরা যতটুকু বুঝতে পেরেছি আরো এক বা একাধিক জঙ্গি ভেতরে আছে।
পুরো বিল্ডিংটা আইইডি দিয়ে নিচের থেকে জায়গায় জায়গায় লাগিয়েছে, আমরাও ফায়ার করেছি এবং তারাও ফায়ার করেছে। পুরো এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে এখন। ওর ভেতরে নড়াচড়া করাটা যথেষ্ঠ ঝুঁকিপূর্ণ।
এরপরও আমাদের কমান্ডোরা সব ঝুঁকিটা নিয়ে চেষ্টা করছে বিভিন্ন সাইট থেকে অ্যাপ্রোচ করে তাদের নিউট্রিলাইজ করার জন্য। তবে এই পর্যন্ত নিউট্রিলাইজ এতটুকু হয়েছে, বাকিটুকু ইনশা আল্লাহ চলতে থাকবে। তবে অপারেশন শেষ করেই আমরা যাব। তবে আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না যে, এগজাক্টলি কখন অপারেশনটা শেষ হবে। তার জন্য আরেকটু ধর্য ধরতে হবে।
তবে আমাদের সেনাসদস্যদের কেউ হতাহত হয়নি। আমরা নিরাপদে আছি।
পুরো বিল্ডিংটার মধ্যে যেহেতু বেশ ঝুঁকিপূর্ণ এই জন্য অপারেশনটা পরিচালনা বেশ ডিফিকাল্ট হচ্ছে এবং এই জন্য সময়টা একটু বেশি লাগছে। আমাদের প্রাইমারি অবজেকটা যেটা ছিল বাসিন্দাদের নিরাপদে উদ্ধার করা সেটা আমরা দ্রুত সময়ে করতে পেরেছি। এরপর আমাদের নিজেদের সদস্যদের নিরাপদে রেখে জঙ্গিদের নির্মূল করা নেক্সট লক্ষ্য। সেটার জন্য আমরা করছি, সেটার জন্য আমাদের তাড়াহুড়া নেই, এজন্য একটু আমরা কেয়ারফুলি যাচ্ছি। এবং আমাদের যে কমান্ড সদস্য যারা আছে তারা বিভিন্ন টেকনিক অ্যাপ্লাই করে আগাচ্ছে।
আজকে সকালে একজন বৃদ্ধা মহিলাকে উদ্ধার করা হয়েছে, তিনি আতিয়া মহলে ছিলেন না। উনি উল্টা পার্শ্বে যে সাদা বিল্ডিংটা ছিল, মানে ওর সামনে একটা সবুজ বাড়ি তারপরে একটা সাদা বাড়ি। গতকাল যখন ওইখানে সমস্ত লোকদের ভ্যাকেট করা হয়েছিল তখন বৃদ্ধ মহিলাকে নিয়ে যেতে পারেননি, উনি ওখানে রয়ে গিয়েছিলেন। আজকে সকালে এসে তাঁকে ওখান থেকে ভ্যাকেট করা হয়েছে।”
প্রশ্নোত্তর পর্ব
প্রশ্ন : মর্জিনা নামে একজন নারী সেখানে থাকার কথা শোনা যাচ্ছিল…
উত্তর : এখনো আমরা নিশ্চিত করতে পারছি না, এক বা একাধিক এখনো ভেতরে আছে। তবে দুজন যতটুকু বোঝা গেছে পুরুষ সদস্য।
প্রশ্ন : অভিযানের সময় তারা কি কোনো পাল্টা জবাব দিয়েছে? কী ধরনের অস্ত্র ছিল?
উত্তর : তাদের কাছে স্মল আর্মস আছে, ফায়ার ব্যাক করেছে, এক্সপ্লোসিভ আছে, আইইডি আছে। তারা বেশ ওয়েল ইকুইপড। আমরা যে গ্রেনেড লপ করেছি, উল্টা তারা আমাদের দিকে ছুড়ে মেরেছে। এক্সপ্লোসিভ ফুটাচ্ছে, সবার মোটামুটি যা দেখলাম যে সুইসাইডাল ভেস্ট লাগানো আছে। আর স্মল আর্মস আছে, ফায়ার করেছে।
প্রশ্ন : আমরা কি ধরতে পারি যে চার থেকে পাঁচজন জঙ্গিকে ঘিরেই এই অপারেশনটা হচ্ছে?
উত্তর : আপাতত সেরকম বলতে পারি।
প্রশ্ন : বাইরে যে আক্রমণটা হয়েছে সেটার সঙ্গে এর কোনো যোগসূত্র থাকতে পারে?
উত্তর : সেটা যারা ইনভাস্টিগেশন করছেন তারা আরো ভালো বলতে পারবেন। নিশ্চয় এখানকার পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ আছে, র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগ আছে। বিকজ আমরা তো সামরিক গোয়েন্দারা এইখানে এই বিষয়গুলো নিয়ে সার্বক্ষণিক ইয়ে করি না। যখন আমাদের ডাক পড়ে তখনই এসে করি। বাট ওনারা আরো এই বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন যে, এদের মধ্যে কতটুকু যোগসাজশ বা আশপাশে কোথাও কিছু আছে কি না।
প্রশ্ন : জঙ্গিরা কারা, আপনারা কি কিছু ধারণা পেয়েছেন?
উত্তর : আমরা তো দৈনন্দিন এই কাজ করি না, আমাদের টার্গেট দেওয়া হয়েছে আমরা সেই টার্গেট ইউটিলাইজ করছি। পুলিশ আরো ভালো বলতে পারবে এরা কোন মতাদর্শের, কোন গ্রুপের বা কারা, ওনারা সেই ইনভেস্টিগেশন পরে করবেন। ওগুলো ডিটেইলস পরে আপনাদের জানাবেন যে এরা কারা কোন গ্রুপের।
প্রশ্ন : যে দুজনের ডেডবডি দেখা গেছে তারা কোন ফ্লোরে?
উত্তর : তারা গ্রাউন্ড ফ্লোরে।