শিশু রাকিব হত্যা : দুজনের সাজা কমাতে যত যুক্তি
খুলনায় পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে শিশু রাকিব হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া দুই আসামি মো. শরীফ ও মিন্টুর আপিলের রায় আগামী ৪ এপ্রিল ঘোষণা করবেন হাইকোর্ট।
ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে অনুমতি চেয়ে আবেদন) ও আসামিদের আপিল শুনানি শেষে আজ বুধবার বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি মোহম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ রায়ের এই দিন নির্ধারণ করেন।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জহিরুল হক। আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরী আলাল ও অ্যাডভোকেট এস এম মুবিনুল ইসলাম।
এ মামলার সর্ব মোট ১২ কার্যদিবস আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানির শেষ দিনে আসামিপক্ষের আইনজীবী গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরী আলাল আসামিদের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে আদালতে বলেন, ‘শিশু রাকিবকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়নি। বরং এটি ছিল দুষ্টামির ছলে একটি দুর্ঘটনা। আর এ বিষয়ে চাক্ষুস কোনো সাক্ষীও নেই।’
এ সময় আদালত বলেন, আসামিরা দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন এবং নিহত রাকিবের মৃত্যুকালীন জবানবন্দি রয়েছে।
এ সময় আইনজীবী বলেন, ‘আসামি শরীফ পায়ুপথে বাতাস ঢুকানোর পর নিহত রাকিবকে খুলনার চারটি হাসপাতালে নিয়ে যায়। এমনকি আসামি মো. শরীফ নিজের শরীরের রক্ত দেন রাকিবকে। এ ঘটনা ছিল আসামিদের চিন্তার বাইরের একটি কাজ। তারা হত্যা করতে চাইলে ঘটনার পরপর নিজেরা হাসপাতালে নিতেন না। এমনকি নিজের শরীরের রক্ত দিতেন না।’
আইনজীবী আরো বলেন, আসামিরা নিজেরা অ্যাম্বুলেন্সে করে রাকিবকে নিয়ে ঢাকার পথে রওনা দেন। পথে তার মৃত্যু হয়। তাই আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা ঠিক হবে না।
জবাবে আদালত বলেন, ‘যেভাবে হোক আসামিরা শিশু রাকিবকে হত্যা করেছে এটি হচ্ছে বড় কথা। একজন মানুষের জীবন নিয়ে কীভাবে দুষ্টামি করা হয়।’ আদালত আরো বলেন, ‘একটি মানুষ মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়বে আর সেটিকে দুষ্টামি বলে চালিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে নিহত রাকিবের মৃত্যুকালীন জবানবন্দি রয়েছে।’
এ সময় রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল জহিরুল হক জহির আদালতে বলেন, রাকিবকে হত্যার ঘটনায় দুই আসামি দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। এমনকি হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় শিশু রাকিব নিজে মৃত্যুকালীন জবানবন্দি দিয়েছে।
এ সময় আদালত বলেন, “শিশু রাকিব মৃত্যুকালীন জবানবান্দিতে বলেছে, ‘মামা (মো.শরীফ) আমাকে বাতাস ঢুকিয়েছেন। মিন্টু মামা আমাকে জোর করে ধরে রাখেন।”
জবাবে আসামিদের আইনজীবী বলেন, মৃত্যুকালীন জবানবন্দি কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেওয়া হয়নি।
জবাবে আদালত বলেন, ‘ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। বরং এটি যে কারো কাছে দিতে পারে। শিশু রাকিব হাসপাতালের চিকিৎসকদের কাছে এ জবানবন্দি দিয়েছে, যা পুলিশ সংগ্রহ করে।’
এ সময় আসামিদের আইনজীবী বলেন, ‘আমরা চাইব আসামিরা যেহেতু পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেননি। বরং এটি ছিল দুষ্টামির ছলে একটি দুর্ঘটনা, তাই আসামিদের ৩০২ ধারার শাস্তি কমিয়ে অন্তুত গলাটা যেন বাঁচে’। পরে আদালত আগামী ৪ এপ্রিল রায়ের জন্য দিন নির্ধারণ করেন।
এর আগে গত ১০ জানুয়ারি এ মামলার পেপার বুক পাঠের মধ্য দিয়ে আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শুরু হয়।
মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০১৫ সালের ৩ আগস্ট খুলনার টুটপাড়া কবরখানার পাশে শরীফ মোটরসে মোটরসাইকেলের হাওয়া দেওয়ার কমপ্রেসর মেশিন দিয়ে শিশু রাকিবের পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ওই গ্যারেজের মালিক মো. শরীফ, তাঁর সহযোগী মিন্টু ও শরীফের মা বিউটি বেগমকে পিটুনি দিয়ে পুলিশে দেয় ক্ষুব্ধ জনতা। ঘটনার পরদিন তিনজনের বিরুদ্ধে খুলনা সদর থানায় হত্যা মামলা হয়। অভিযুক্ত তিনজনই ঘটনার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। এর পরই দ্রুত সময়ের মধ্যে মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ।
হত্যাকাণ্ডের চার মাসের মধ্যেই খুলনার দায়রা আদালত ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর আসামি শরীফসহ দুজনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। পরে মৃতুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিরা রায় বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে আপিল করেন। সে সময় মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য হাইকোর্টে মামলাটি ডেথ রেফারেন্স আকারে পাঠানো হয়।