শিশু রাকিব হত্যা : দুজনের মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন
খুলনায় পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে শিশু রাকিব হত্যা মামলায় দুই আসামি মো. শরীফ ও মিন্টুর মৃত্যুদণ্ডাদেশ কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাঁদের ৫০ হাজার করে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এই টাকা রাকিবের পরিবারকে দিতে হবে।
আজ মঙ্গলবার বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন।
রায়ে আদালত বলেন, হত্যাকাণ্ডের পর দুই আসামি রাকিবকে হাসপাতালে নিয়েছে এবং রক্ত দিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে বলে তাঁদের আইনজীবীরা বলেছেন। এ ছাড়া তাঁরা পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ছিল না মর্মেও আদালতে আবেদন করেছেন। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আদালত দুই আসামির সাজা কমিয়েছেন।
এর আগে ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল শুনানি শেষে গত ২৯ মার্চ বুধবার বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের ডিভিশন বেঞ্চ রায়ের এ দিন নির্ধারণ করেন।
এ মামলায় আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জহিরুল হক। আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরী আলাল ও এস এম মুবিনুল ইসলাম। বাদীপক্ষে ছিলেন আইনজীবী সালমা সুলতানা।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় রাকিবের পক্ষের আইনজীবী সালমা সুলতানা বলেন, আদালত একদিকে বলেছেন, ১০০ বছরের ইতিহাসে এটি নিষ্ঠুর ও জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড, অপরদিকে আসামিদের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন দিয়েছেন। রায়টি সাংঘর্ষিক। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জহিরুল হক সাংবাদিকদের বলেন, দুই আসামি রাকিবকে হত্যা করার পর আবার বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল। এ বিষয়টি আমলে নিয়ে আদালত দণ্ড কমিয়েছেন। রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হওয়ার পর আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এ মামলার সর্বমোট ১১ কার্যদিবসে আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানির শেষ দিনে আসামিপক্ষের আইনজীবী গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরী আলাল আসামিদের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে আদালতে বলেন, ‘শিশু রাকিবকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়নি; বরং এটি ছিল দুষ্টুমির ছলে একটি দুর্ঘটনা। আর এ বিষয়ে চাক্ষুস কোনো সাক্ষীও নেই।’
এ সময় আদালত বলেন, ‘আসামিরা দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। নিহত রাকিবের মৃত্যুকালীন জবানবন্দি রয়েছে।’
এ সময় আইনজীবী বলেন, ‘আসামি শরীফ পায়ুপথে বাতাস ঢোকানোর পর নিহত রাকিবকে খুলনার চারটি হাসপাতালে নিয়ে যায়। এমনকি শরীফ নিজের শরীরের রক্ত প্রদান করে শিশু রাকিবকে। এ ঘটনা ছিল আসামিদের চিন্তার বাইরের একটি কাজ। তারা হত্যা করতে চাইলে ঘটনার পর পর নিজেরা হাসপাতালে নিত না। এমনকি নিজের শরীরের রক্ত প্রদান করত না।’
আইনজীবী আরো বলেন, ‘আসামিরা নিজেরা অ্যাম্বুলেন্সে করে রাকিবকে ঢাকার পথে রওনা দেয়। পথের মধ্যে তার মৃত্যু হয়। তাই আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা ঠিক হবে না।’
জবাবে আদালত বলেন, ‘যেভাবে হোক আসামিরা শিশু রাকিবকে হত্যা করেছে। এটি হচ্ছে বড় কথা। একজন মানুষের জীবন নিয়ে কীভাবে দুষ্টুমি করা হয়।’
আদালত আরো বলেন, ‘একটি মানুষ মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়বে আর সেটিকে দুষ্টুমি বলে চালিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না।’
বক্তব্য শেষে আদালত ৪ এপ্রিল রায়ের জন্য দিন নির্ধারণ করেন।
এর আগে গত ১০ জানুয়ারি এ মামলার পেপারবুক পাঠের মধ্য দিয়ে আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শুরু হয়।
মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০১৫ সালের ৩ আগস্ট খুলনার টুটপাড়া কবরখানার পাশে শরীফ মোটরসে মোটরসাইকেলের হাওয়া দেওয়ার কমপ্রেসর মেশিন দিয়ে শিশু রাকিবের পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ওই গ্যারেজের মালিক মো. শরীফ, তাঁর সহযোগী মিন্টু ও শরীফের মা বিউটি বেগমকে পিটুনি দিয়ে পুলিশে দেয় ক্ষুব্ধ জনতা। ঘটনার পরদিন তিনজনের বিরুদ্ধে খুলনা সদর থানায় হত্যা মামলা হয়। অভিযুক্ত তিনজনই ঘটনার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। এর পরই দ্রুত সময়ের মধ্যে মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ।
হত্যাকাণ্ডের চার মাসের মধ্যেই খুলনার দায়রা আদালত ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর আসামি শরীফসহ দুজনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। পরে মৃতুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিরা রায় বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে আপিল করেন। সে সময় মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য হাইকোর্টে মামলাটি ডেথ রেফারেন্স আকারে পাঠানো হয়।