‘আমি নায়ক, খলনায়ক’ বলেই লাঠি দিয়ে গুঁতা মারে রাজনকে
সিলেটে শিশু সামিউল আলম রাজন হত্যা মামলার রায় দেওয়ার সময় মামলার আসামি সাদিকুর রহমান ওরফে ময়না চৌকিদারের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পড়ে শোনান আদালত। জবানবন্দিতে আসামি ময়না হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন।
ময়না চৌকিদার বলেন, ‘ঘটনার দিন ২০১৫ সালের ৮ জুলাই সকাল ৬টার সময় মার্কেটের সামনে লায়েক ভলকানাইজিং দোকানের সামনে ছিলাম। উক্ত মার্কেটের আমি নাইটগার্ড ছিলাম। এ সময় লায়েকের দোকানে একটি লম্বা লোক বসা ছিল। তিনি আমাকে ডেকে বলেন, পাশের আলীর দোকানের ভ্যানগাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। আমি দৌড়ে গিয়ে রাজন নামের ছেলেটাকে ধরি। পরে পাশের মার্কেটের ফিরোজ চৌকিদার আগাইয়া আসে এবং বলে ভাতিজা চোররে বাইন্দা থো। তখন নাম জানি না লম্বা একটি লোক দড়ি আইনা আমাকে দিলে আমি তাকে মার্কেটের পিছনে বাইন্দা রাখি। পরে দোকানদার শামীমকে (আসামি) খবর দিলে সে বলে ছেলেরে বেঁধে রাখ। এরপরে কামরুল ইসলাম (মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত প্রধান আসামি) জাকির হোসেন পাভেলকে সঙ্গে নিয়ে আসে। কামরুল আইসা রাজনের গালে চড়থাপ্পড় মারে।’
ময়না বলেন, “আমার হাতে একটি কাপড় পেঁচানো লাঠি ছিল। কামরুল আমার হাত থেকে লাঠি নেয়। এরপর কামরুল লাঠিকে তার লুঙ্গিতে প্যাঁচায়ে পিছনে ঘুরাইতেছে। আর বলে, ‘আমি নায়ক, খলনায়ক’। এরপর লাঠি দিয়ে শিশু রাজনকে গুঁতা মারে। পরে পাশের মার্কেট থেকে আসা নূর আহমদ এসে তাঁর মোবাইল ফোন বাহির করে। ওই সময় কামরুল বলেন, ‘বন্ধু বিদেশে থাইকা আইছি, হাতে চুলকায়। তুই ভিডিও কর’। বন্ধু-বান্ধবকে হোয়াটসঅ্যাপে বিদেশে ভিডিও পাঠাইব। আমি মারি, তুই ভিডিও কর। এর পর কামরুল রাজনকে মারধর শুরু করে। ১০ থেকে ১৫ মিনিট মারধরের পর আমাকে কামরুল বলে শালাকে মার্কেটের পিছনে নিয়ে যা। এরপর আমি পিছনে নিয়ে বাঁধার পর কামরুল আবার শিশু রাজনকে মারধর শুরু করে।”
‘তোর মার নাম কিতা?’
ময়নার ভাষ্য মতে, “কামরুল রাজনকে বলে, ‘তোর মার নাম কিতা? তোর বাবার নাম কিতা? তোর মাকে আমার কাছে বিয়া দিবিনি? তোর বোনকে আমার সাথে বিয়া দিবিনি?’ কামরুল রাজনকে মারতে মারতে বলে আমাকে দুলা ভাই ডাক। এ সময় রাজন দুলা ভাই ডাকার পর কামরুল বলে, আমি তোর দুলা ভাই না?”
‘এ সময় রাজন মাইর খেতে খেতে বলে উঠে, আমার মারে বিয়া দিমু তোমার কাছে। কিন্তু কামরুল মারতে থাকে। এ সময় পাভেলও মারতে থাকে। এ সময় নিহত রাজন আসামি কামরুলের কাছে পানি চায়। তখন কামরুল হাতের লাঠিটা ড্রেন থেকে ভিজাইয়া এনে রাজনের মুখে দেয়। রাজন ওই লাঠির পানি চাইট্যা খাই। কামরুল আবার মাইর শুরু করে। এরপর রাজন আবার বলে মামা আমাকে পানি দাও। তখন কামরুল বলে কুত্তার বাইচ্ছা, তোর ঘাম মইছা খাও। এরপর রাজন তার মুখের ঘাম মুছে চাইট্যা খাইতে থাকে।’
‘রাজন আস্তে আস্তে জানি কী বলতেছে’
ময়না বলেন, “কামরুলের মাইরের ১০ মিনিট পর দেখি কালো বাদল নামে কালো লোক লাফাইয়া লাফাইয়া রাজনকে মারছে। তখন আমার মায়া হয়। আমি মারার জন্য নিষেধ করি। এ সময় আসামি কামরুলের ভাই শামীম এবং আলী আসে। কিছুক্ষণ পর দেখি শামীম একবার পিছনে যায়, আবার সামনে আসে। এ সময় আমার মনের মধ্যে বাড়ি খায়। আমি দৌড়ে গিয়ে দেখি রাজনের হাতের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়েছে। এরপর রাজন আমাকে বলে, ‘বাড়ি নিয়া যাওরে’। আমি রাজনকে বলি তোমার বাড়ির ঠিকানা দাও।”
‘এরপর দেখি রাজন আস্তে আস্তে কী জানি বলতাছে। পরে আমি ভয়ে মুহিতকে বললাম, ছেলের (রাজন) অবস্থা খুব খারাফ। এ সময় আবার দৌড়াইয়া গিয়ে দেখি রাজন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। তার কোনো নড়াছড়া নেই। সাড়া শব্দ নেই।’
ময়না চৌকিদারের উল্লিখিত এসব বক্তব্যের পর আদালত আসামিদের দণ্ড ঘোষণা করেন। প্রধান আসামি কামরুলসহ চারজনের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখা হয়। সেই সঙ্গে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ পাওয়া আসামি নূর মিয়ার সাজা কমিয়ে ছয় মাসের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।
বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ শুনানি শেষে এসব রায় ঘোষণা করেন।
২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর রাজন হত্যা মামলায় আসামি কামরুলসহ চারজনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আদালত। ওই সময় একজনকে যাবজ্জীবন ও পাঁচজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। বেকসুর খালাস দেওয়া হয় তিনজনকে।
ফাঁসির দণ্ডাদেশ পাওয়া চারজন হলেন- মামলার প্রধান আসামি সিলেটের জালালাবাদ থানাধীন শেখপাড়া গ্রামের কামরুল ইসলাম, পীরপুর গ্রামের সাদিক আহমদ ময়না ওরফে ময়না চৌকিদার, শেখপাড়া গ্রামের তাজ উদ্দিন বাদল ও সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ঘাগটিয়া গ্রামের জাকির হোসেন ওরফে পাভেল। এর মধ্যে জাকির হোসেন ওরফে পাভেল বর্তমানে পলাতক।
আদালত জালালাবাদ থানাধীন পূর্ব জাঙ্গাইল গ্রামের নূর মিয়া ওরফে নূর আহমদকে যাবজ্জীবন, শেখপাড়া গ্রামের দুলাল আহমদকে ১০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন। লাশ গুমের চেষ্টার দায়ে আসামি কামরুলের ভাই শেখপাড়া গ্রামের মুহিদুল ইসলাম মুহিত, আলী হায়দার ও শামীম আহমদকে সাত বছর করে এবং সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার জাহাঙ্গীরগাঁও গ্রামের আয়াজ আলীকে এক বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে আসামি শামীম আহমদ পলাতক।
বেকসুর খালাস পান জালালাবাদ থানাধীন হায়দরপুর গ্রামের রুহুল আমীন, কুমারগাঁও গ্রামের আজমত উল্লাহ ও সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার দক্ষিণ কুর্শি ইসলামপুর গ্রামের ফিরোজ আলী।
গত ১২ মার্চ মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিদের করা আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শেষ হয়। এর আগে ৩০ জানুয়ারি রাজন হত্যা মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শুরু হয়।
গত বছরের ১০ নভেম্বর রাজন হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে এসে পৌঁছায়। পরে প্রধান বিচারপতির নির্দেশে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক প্রস্তুত করা হয়।
২০১৫ সালের ৮ জুলাই চুরির অপবাদে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন শেখপাড়ায় নির্যাতন করে হত্যা করা হয় সিলেটের জালালাবাদ থানা এলাকার বাদেয়ালি গ্রামের সবজি বিক্রেতা শিশু রাজনকে। লাশ গুম করার সময় ধরা পড়ে একজন।
পরে পুলিশ বাদী হয়ে জালালাবাদ থানায় মামলা করে। ফেসবুকে প্রচারের উদ্দেশে নির্যাতনের ভিডিওচিত্র ধারণ করে আসামিরা।