এক চালকের শ্বশুরবাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন ‘নাঈম আশরাফ’
রাজধানীর বনানীতে দুই ছাত্রী ধর্ষণ মামলার অন্যতম আসামি হাসান মোহাম্মদ হালিম ওরফে নাঈম আশরাফ সাতদিনের পুলিশের রিমান্ডে আছেন। গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার কুমারভোগ ইউনিয়নের মৌছামান্দ্রা গ্রামে এক পিকআপচালকের শ্বশুরবাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে লুকিয়ে ছিলেন চারদিন। এর আগে তিনি কোথায় ছিলেন তা জানা যায়নি।
এদিকে ঢাকা থেকে পুলিশ সদর দপ্তরের বিশেষ দল অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে গ্রেপ্তার অভিযান চালায়। স্থানীয় থানা পুলিশও জানত না নাঈম আশরাফকে গ্রেপ্তারের জন্য ঢাকা থেকে পুলিশের দল আসছে। লৌহজং থানা পুলিশকে শুধু অবহিত করা হয় যে ঢাকা থেকে গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল লৌহজংয়ে একটি অভিযান চালাবে।
লৌহজং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আনিচুর রহমান বলেন, ‘আমাদের শুধু জানানো হয়েছে একটি অভিযান পরিচালিত হবে। কিন্তু কোথায় এবং কীভাবে তা আমাদের অবহিত করা হয়নি। এমনকি আসামিকে আটকের পর তাকে নিয়ে ঢাকার পথে রওনা দেয় পুলিশের বিশেষ দলটি। তাই আমরা এ ব্যাপারে বলতে গেলে কিছুই জানি না।’
ওসি আরো বলেন, ‘অভিযান সমাপ্তির পর আমরা জানতে পারি যে মৌছামান্দ্রা গ্রামের আকুব আলী মাতব্বরের বাড়ি থেকে ধর্ষণ মামলার আসামি নাঈমকে ধরা হয়েছে।’
আজ বৃহস্পতিবার আকুব আলী মাতব্বরের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আকুব আলী বাড়িতে নেই। তাঁর ছেলের বউ আলেয়া বেগম জানান, স্ত্রীকে নিয়ে আকুব আলী গতকালই বেড়াতে গেছেন। ননদের জামাই নুরুল ইসলাম ঢাকায় পিকআপ গাড়ি চালান। তিনি চারদিন আগে ওই লোককে (নাঈম আশরাফ) নিয়ে বাড়িতে আসেন।
স্থানীয় কুমারভোগ ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য কামাল হোসেন বলেন, ‘গতকাল একটি মাইক্রোবাসে করে সাদা পোশাকে এসে পুলিশ এক আসামিকে ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু, আমরা বুঝতেই পারিনি ধর্ষণ মামলার আসামি নাঈম আশরাফকে পুলিশ আটক করেছে।’
গতকাল রাতে নাঈম আশরাফকে গ্রেপ্তারের পর আজ ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘ধরা পড়ার পর গভীর রাতে নাঈম আশরাফকে নিয়ে আসা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার সত্যতা সে স্বীকার করেছে। বাকি আসামিদের যার যা ভূমিকা ছিল, সেটি অনেকটাই স্বীকার করেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত আছে। সেখান থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।’
এই পুলিশ কর্মকর্তা আরো জানান, বনানীর ঘটনায় আর কারো মদদ আছে কি না এবং ওই দিনের প্রকৃত ঘটনা কী ছিল, তা বের করতে নাঈম আশরাফকে রিমান্ডে নেওয়া হবে। এর পর বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদে আরো তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে আশা করছেন গোয়েন্দারা।
এদিকে আসামি নাঈম আশরাফের প্রকৃত নাম হাসান মোহাম্মদ হালিম। তিনি তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় নিয়েও জালিয়াতি করেছেন। নিজেকে সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি হালিম হিসেবে পরিচয় দিলেও আসল হালিম তিনি নন। তিনি কাজীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি চেয়ারম্যান আশরাফুল আলমের ছেলে নাঈম আশরাফের নাম ব্যবহার করে একটি বেসরকারি টেলিভিশন ও ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান ই-মেকার্সে কাজ করতেন। আওয়ামী লীগ নেতার ছেলে নাঈম আশরাফ ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন।
কাজীপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি সেলিম রেজা জানান, কাজীপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সহসভাপতি হিসেবে রয়েছেন গান্ধাইল ইউনিয়নের চৌরাস্তা গ্রামের বাসিন্দা স্থানীয় কারিগরি কলেজের শিক্ষক আবদুল হালিম, যিনি কালো হালিম নামে পরিচিত। অথচ ওই ব্যক্তির নাম ও পদবি ব্যবহার করেই প্রতারক হাসান মোহাম্মদ হালিম ওরফে নাঈম আশরাফ নিজেকে কাজীপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি পরিচয় দিয়ে এলাকায় ব্যানার-ফেস্টুনে ছেয়ে দেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলা গান্ধাইল গ্রামের আমজাদ হোসেন ফেরিওয়ালার ছেলে এইচ এম হালিম। ২০০৪ সালে এসএসসি পাস করে বগুড়া পলিটেকনিকে ভর্তি হন। সেখানেও নিজের বাবার নামসহ পুরো পরিচয় গোপন করে প্রতারণা করে প্রেম ও বিয়ে করেন। ধরা পড়ে গণপিটুনি খেয়ে সেখান থেকে পালিয়ে ঢাকায় গিয়ে নাম বদলে হয়ে যান নাঈম আশরাফ। চাকরি নেন একটি গণমাধ্যমে। এর পর থেকেই দীর্ঘদিন তাঁর কোনো খবর ছিল না। হঠাৎ করেই নিজেকে কাজীপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি পরিচয় দিয়ে এলাকায় ব্যানার-ফেস্টুন লাগান। আর এতেই আবার নজরে আসেন হালিম ওরফে নাঈম আশরাফ। তবে তাঁর রাজনৈতিক কোনো পরিচয় নেই বলে জানিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের মামলায় এর আগে আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদ, তাঁর বন্ধু সাদমান সাকিফ, সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল ও দেহরক্ষী রহমত আলীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর মধ্যে সাফাত ও সাদমান সাকিফ ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আজ আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। পরে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। অন্য তিন আসামি রিমান্ডে আছেন।
জন্মদিনের পার্টিতে ডেকে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ এনে গত ৬ মে বনানী থানায় মামলা করেন এক ছাত্রী। ওই মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, গত ২৮ মার্চ রাত ৯টা থেকে পরের দিন সকাল ১০টা পর্যন্ত আসামিরা মামলার বাদী এবং তাঁর বান্ধবী ও বন্ধু শাহরিয়ারকে আটক রাখেন। অস্ত্র দেখিয়ে ভয়-ভীতি প্রদর্শন ও অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করেন। বাদী ও তাঁর বান্ধবীকে জোর করে ঘরে নিয়ে যান আসামিরা। বাদীকে সাফাত আহমেদ একাধিকবার এবং বান্ধবীকে নাঈম আশরাফ একাধিকবার ধর্ষণ করেন। আসামি সাদমান সাকিফকে দুই বছর ধরে চেনেন মামলার বাদী। তাঁর মাধ্যমেই ঘটনার ১০-১৫ দিন আগে সাফাতের সঙ্গে দুই ছাত্রীর পরিচয় হয়।
এজাহারে আরো বলা হয়েছে, ঘটনার দিন সাফাতের জন্মদিনে দুই ছাত্রী যান। সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল ও দেহরক্ষী তাঁদের বনানীর ২৭ নম্বর রোডের দ্য রেইনট্রি হোটেলে নিয়ে যান। হোটেলে যাওয়ার আগে বাদী ও তাঁর বান্ধবী জানতেন না সেখানে পার্টি হবে। তাঁদের বলা হয়েছিল, এটা একটা বড় অনুষ্ঠান, অনেক লোকজন থাকবে। অনুষ্ঠান হবে হোটেলের ছাদে। সেখানে যাওয়ার পর তাঁরা ভদ্র কোনো লোককে দেখেননি। সেখানে আরো দুই তরুণী ছিলেন। বাদী ও বান্ধবী দেখেন সাফাত ও নাঈম ওই দুই তরুণীকে ছাদ থেকে নিচে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এই সময় বাদীর বন্ধু ও আরেক বান্ধবী ছাদে আসেন। পরিবেশ ভালো না লাগায় তাঁরা চলে যেতে চান। এই সময় আসামিরা তাঁদের গাড়ির চাবি শাহরিয়ারের কাছ থেকে নিয়ে নেন। তাঁকে খুব মারধর করেন। ধর্ষণ করার সময় সাফাত গাড়িচালককে ভিডিওচিত্র ধারণ করতে বলেন। বাদীকে নাঈম আশরাফ মারধর করেন এবং তিনি প্রতিবাদ করবেন বলে জানিয়েছিলেন। এরপর বাদী ও বান্ধবীর বাসায় দেহরক্ষী পাঠানো হয় তথ্য সংগ্রহের জন্য। তাঁরা এতে ভয় পেয়ে যান। লোকলজ্জার ভয় এবং মানসিক অসুস্থতা তাঁরা কাটিয়ে উঠে পরে আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে আলোচনা করে মামলার সিদ্ধান্ত নেন। এতে মামলা করতে বিলম্ব হয়।