সরকার সুপ্রিম কোর্টকে কবজায় নিতে চায় : প্রধান বিচারপতি
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহা অভিযোগ করে বলেছেন, নিম্ন আদালতের মতো সর্বোচ্চ আদালত তথা সুপ্রিম কোর্টকেও কবজায় নিতে চায় সরকার।
বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল শুনানিকালে আজ মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি এই মন্তব্য করেন।
আপিল বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিয়া, বিচারপতি ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার।
আজ পঞ্চম দিনের মতো শুনানিকালে রাষ্ট্রপক্ষে অংশ নেন অ্যার্টনি জেনারেল মাহবুবে আলম। শুনানিতে তিনি বলেন, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা। সাংবিধানিক বিষয় এখানে জড়িত। তাই আপিল বিভাগের সাত বিচারপতিকে এ মামলায় সম্পৃক্ত রাখা হোক। দুজন বিচারপতি শুনানির বাইরে আছেন। তাঁদেরসহ যেন শুনানি করা হয়।
এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, এ অবস্থাতে বিচারপতিদের অপসারণ বা ইত্যাদির বিষয়ে কোনো আইন নাই। কাজেই এ বিষয়ে ত্বরিত গতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আমি বলছি, হ্যাঁ নেওয়া উচিত। সবাইকে (সকল বিচারপতিকে) যুক্ত করে এবং আমাকে কিছু সময় দিয়ে। আপনি বলেছেন, এ মাসেই শেষ করা সম্ভব। আমি বলেছি অবশ্যই শেষ করা সম্ভব। পুরো মে মাস পড়ে আছে। বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন যাতে শুনানিতে অংশ নেন, সেই জন্য তাঁদের তালিকায় রাখা। ওনারা (বিচারপতিগণ) না আসা পর্যন্ত এবং আমাদের প্রস্তুতির জন্য সময় প্রার্থনা করেছিলাম। সবাইকে যদি যুক্ত না করেন, আমি হয়তো এ মামলা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করার চিন্তাও করতে পারি।’
জবাবে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘সেটি দেখব।’
এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, সংসদ সদস্যদের মধ্যে একটা বিরাট অংশের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে। সংসদ সদস্যদের মধ্যে কারা কারা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত এর তালিকা চাওয়া হোক।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এগুলো আমরা শুনানির সময় বা রায়ের সময় দেখব।’
জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সংসদ সদস্যরা ক্রিমিনাল—এটি যদি সঠিক না হয়, তাহলে রায় প্রদানকারী ওই বিচারপতিকে অপসারণ করা উচিত।
জবাবে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এটি আপনি কী বলছেন? নিম্ন আদালতের মতো এটিকে (সুপ্রিম কোর্ট) কবজায় নিতে চায় সরকার।’
প্রধান বিচারপতির মন্তব্যের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘এটা পলিটিক্যাল ইস্যু। অনেক ইস্যু থাকে। ভাস্কর্যও একটা ইস্যু হয়ে গেছে।’
এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এটা পলিটিক্যাল ইস্যু নয়। এটার সাথে ওটা মিলাবেন না। নিম্ন আদালতের বিচার পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। তাহলে আপনি উত্তর দেন, একটা জেলায় যদি পাঁচ মাস ধরে জেলা জজ না থাকে তাহলে বিচার কীভাবে চলে?’
উত্তরে অ্যাটর্নি জেনারেল জানান, ‘বিচার বিভাগ যখনই অকার্যকর হয়ে যাবে, তখন দেশে অরাজকতা চলতে থাকবে।’
এরপর প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘নিম্ন আদালত মানেই আইন মন্ত্রণালয়। এখন উচ্চ আদালতকে পার্লামেন্টের কাছে নিয়ে গেছেন। তাহলে বিচার বিভাগের কী থাকল?’
অ্যাটর্নি জেনারেল তাঁর জবাবে বলেন, ‘বিচার বিভাগ এটা বলতে পারে না।’
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আইন না থাকলেও রাষ্ট্রপতি বিচারপতি অপসারণ করতে পারবেন।
এ সময় প্রধান বিচারপতি ক্ষুব্দ হন। তিনি বলেন, এটা আপনি কি বললেন। আপনি তো হাজার বছরে পেছনে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেন।
ওই বক্তব্যের পর মামলার কার্যক্রম আগামীকাল বুধবার পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করেন আপিল বিভাগ।
অ্যাটর্নি জেনারেল ও রিটকারী আইনজীবীর বক্তব্য
আপিল বিভাগে চলমান শুনানির বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা দুটি দরখাস্ত দাখিল করেছি আদালতে। একটি দরখাস্ত দাখিল করেছি হাইকোর্ট বিভাগ তার রায়ে একটি জায়গায় বলেছেন, সংসদ সদস্যদের মধ্যে একটা বিরাট অংশের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে। সেটাই আমি দরখাস্ত করেছি আদালতে, যে সংসদ সদস্যদের মধ্যে কারা কারা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত এ তালিকা চাওয়া হোক।’
‘আদালত বলেছেন, এগুলা আমরা শুনানির সময় বা রায়ের সময় দেখব। আরেকটি দরখাস্ত করেছিলাম দুজন বিচারপতি বাইরে আছেন, তাঁদেরসহ যাতে শুনানি করা হয়। এ বিষয়টির ওপর আমি আগা-গোড়াই জোর দিচ্ছি। যেহেতু এটা সাংবিধানিক ব্যাপার, সেহেতু আপিল বিভাগের সব কয়জন বিচারপতি যাতে শুনানিতে অংশ নেন, এটা কিন্তু আমি প্রথম থেকেই বলে আসছি, আজও বলছি।’
রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ শুনানির পরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘ষোড়শ সংশোধনীর মামলায় বেশ কয়েক দিন থেকে পূর্ণাঙ্গ সময় ধরেই শুনানি চলছে। শুনানির প্রথম দিকেই আজকে লার্নড অ্যাটর্নি জেনারেল তাঁর লিখিত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করছিলেন এবং উপস্থাপন করাকালীন সর্বশেষ সময় যখন সোয়া ১টা বেজে গেছে। নরমালি কোর্ট নেমে যাওয়ার কথা। ওই সময়েই তাঁর লিখিত যুক্তিতর্কের একটি জায়গায় তাঁর একটা মন্তব্যটা এসেছে, সেখানে বলা হয়েছে যে, উনি লিখিত যুক্তিতর্কে তিনি যেটা বলেছেন, সেটা হলো যে, এই যে মন্তব্যগুলো জজ করেছেন, ক্রিমিনাল রেকর্ড সংসদ সদস্যদের। এগুলো যদি প্রমাণিত না হয়, তবে সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
‘এ রকম লিখিত যুক্তিতর্কের প্রশ্নে তখন প্রধান বিচারপতি জানতে চেয়েছেন, এটা কীভাবে সম্ভব। বিচারককে রাষ্ট্রপতি ইচ্ছ করলেই অপসারণ করতে পারেন। এই নিয়ে যখন আলোচনা হচ্ছিল। তখন অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, এটা আমার বক্তব্য, আপনারা যদি কিছু বলতে চান এটার ব্যাপারে। তাহলে সেটা বলতে পারেন। মামলার রায়ে সেটা রিফ্লেকশন হবে। এই নিয়ে কথা হচ্ছিল।’
মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘লিখিত যুক্তিতর্কে অ্যাটর্নি জেনারেল অনেক কিছুই বলেছেন, মূলত বিচারকের রায় নিয়ে। আসলে আমরা যখন আপিল করি তখন কিন্তু হাইকোর্ট ডিভিশনের রায়ের বিরুদ্ধে বলতে পারি যে, সেখানে কোনো আইনগত ভুল হয়েছে, কী ভুল হয়েছে না হয়েছে, যাতে আদালত বারবার আপত্তি উত্থাপন করছিলেন। অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে আপনি এটা বলতে পারেন না।’
‘উনি অনেকগুলো ল্যাংগুয়েজের ব্যাপারে বলেছেন যে, উনি লিখিত যে যুক্তিতর্ক সেটা সংশোধন করেন, যে সমস্ত আপত্তিকর কথা রয়েছে সেগুলো বাদ দিয়ে দিবেন। উনি এটা কমিটমেন্ট করেছেন।’
এর আগে গত ৮, ৯ এবং ২১ ও ২২ মে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। গত ৮ ফেব্রুয়ারি এ মামলায় আপিল শুনানিতে সহায়তার জন্য ১২ জন আইনজীবীকে আদালতের বন্ধু (অ্যামিকাস কিউরি) হিসেবে নিয়োগ দিয়ে তাঁদের লিখিত বক্তব্য আদালতে জমা দিতে বলেন আপিল বিভাগ।
অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত ১২ আইনজীবী হচ্ছেন—বিচারপতি টি এইচ খান, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, এ এফ হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, এ জে মোহাম্মদ আলী, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, ফিদা এম কামাল, ব্যারিস্টার আজমালুল হক কিউসি, আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া ও এম আই ফারুকী।
বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে আনতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস করা হয়। পরে ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়।
পরে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয়জন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন।
এ আবেদনের ওপর প্রাথমিক শুনানি শেষে হাইকোর্ট ওই সংশোধনী কেন অবৈধ, বাতিল ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন।
এ রুলের ওপর শুনানি শেষে গত ৫ মে আদালত সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকের মতামতের ভিত্তিতে ১৬তম সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেন। তিন বিচারকের মধ্যে একজন রিট আবেদনটি খারিজ করেন।
এর মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠদের মতামতের ভিত্তিতে রায় প্রকাশিত হয় গত বছরের ১১ আগস্ট এবং রিট খারিজ করে দেওয়া বিচারকের রায় প্রকাশিত হয় ৮ সেপ্টেম্বর। দুটি মিলে মোট ২৯০ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে পরে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। ওই আপিলের ওপর শুনানি চলছে।
হাইকোর্টের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইনসভার কাছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা রয়েছে। দেশের সংবিধানেও শুরুতে এই বিধান ছিল। তবে সেটি ইতিহাসের দুর্ঘটনা মাত্র।
রায়ে আরো বলা হয়, কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর ৬৩ শতাংশের অ্যাডহক ট্রাইব্যুনাল বা ডিসিপ্লিনারি কাউন্সিলরের মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণের বিধান রয়েছে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানটি তুলে দিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হয়। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ৯৬ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন এনে বিচারকের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে পুনরায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়, যেটি ১৯৭২ সালের সংবিধানেও ছিল।