‘কেউ আমার আঙুলের নখটি পর্যন্ত দেখতে পাবে না’
একসময়ের আলোচিত নাম নাজনীন আক্তার হ্যাপী। ঢাকাই চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয়জীবন, ক্রিকেটার রুবেল হোসেনকে ঘিরে বিতর্ক—সবই ছিল এ দেশের সংবাদমাধ্যমে বহুল আলোচিত।
কিন্তু সবাইকে অবাক করে চলচ্চিত্রের রঙিন দুনিয়া ছেড়ে বোরখায় ঢেকে ফেলেছেন নিজের জীবন। হয়ে গেছেন পুরোদস্তুর ধার্মিক। পাল্টেছেন নিজের নামও। হ্যাপী হয়েছেন ‘আমাতুল্লাহ’। আরবি এই শব্দটির বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘আল্লাহর দাসী’।
সম্প্রতি নিজের জীবনের এই রোমাঞ্চকর পরিবর্তন নিয়ে বিস্তৃত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন হ্যাপী। আর ওই সাক্ষাৎকার বই হিসেবে বাজারে এনেছে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘মাকতাবাতুল আজহার’। ‘হ্যাপী থেকে আমাতুল্লাহ’ নামে ওই বইটি নিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বার্তা সংস্থা এএফপি।
আজ বুধবার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে ‘হ্যাপী থেকে আমাতুল্লাহ’ বইটি সম্পর্কে নাজনীন আক্তার হ্যাপী, বইয়ের লেখিকা সাদেকা সুলতানা সাকি, বইটির সহলেখক সাকির স্বামী আবদুল্লাহ আল ফারুক ও ‘মাকতাবাতুল আজহার’-এর মালিক মোহাম্মদ ওবায়েদুল্লার বক্তব্য প্রকাশিত হয়।
‘হ্যাপী থেকে আমাতুল্লাহ’ বইয়ে নাজনীন আক্তার হ্যাপী বলেছেন, আগের জীবনের নাম-পরিচয় মুছে ফেলার পর নিজেকে সদ্যজাত শিশুর মতো মনে হচ্ছে, ‘এখন আগের জীবনের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। সেটা এক ভিন্ন মানুষের গল্প ছিল।’
এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ, যেখানে নৈতিকতার গল্পগুলোই সর্বাধিক জনপ্রিয়তার তালিকায় থাকে, সেই রক্ষণশীল সমাজে সাবেক চিত্রনায়িকা নাজনীন আক্তার হ্যাপীর পরিবর্তনের গল্প রোমাঞ্চকরই বটে। একসময় একটি স্ক্যান্ডালের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল হ্যাপীর নাম। সেখান থেকে বেরিয়ে বোরখা পরে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার কাজের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার গল্পটি অনেককেই নাড়া দিয়েছে।
‘হ্যাপী থেকে আমাতুল্লাহ’ অথবা ‘চলচ্চিত্র নায়িকা থেকে আল্লাহর দাসী’ একটি ব্যতিক্রমী বিস্তৃত সাক্ষাৎকার বলেও উল্লেখ করেছে এএফপি।
বইটির প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান ‘মাকতাবাতুল আজহার’-এর মালিক মোহাম্মদ ওবায়েদুল্লাহ জানান, সারা দেশে বইটির কাটতি অভিভূত করেছে তাঁকে। ‘সবাই জানতে চায়, কী স্পৃহা তাঁকে তারকার জীবনযাত্রা থেকে সরিয়ে একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমানের জীবনযাপনে অনুপ্রাণিত করেছে’, বলেন তিনি।
মোহাম্মদ ওবায়েদুল্লাহ আরো জানান, তাঁর প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান কেবল ইসলামী বই-ই বাজারজাত করে।
আগের জীবনের গল্প
ঢালিউড তারকা হ্যাপীর বাংলা চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় ২০১৩ সালে। সে বছর ‘কিছু আশা কিছু ভালোবাসা’ নামে একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি।
এর পর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি হ্যাপীকে। খুব দ্রুতই তিনি ভক্তদের মনে জায়গা করে নিচ্ছিলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তিনি ছিলেন তুমুল জনপ্রিয়।
কিন্তু ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেটের তারকা ফাস্ট বোলার রুবেল হোসেনের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনেন হ্যাপী। এরপরই ক্রিকেটপাগল বাঙালির মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর নাম।
হ্যাপীর অভিযোগ ছিল, ২৫ বছর বয়সী ক্রিকেটার রুবেল বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁর সঙ্গে ‘অন্তরঙ্গ সম্পর্ক’ গড়ে তুলেছিল। কিন্তু পরে রুবেল প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে।
মুসলিমপ্রধান বাংলাদেশে বিয়ে ছাড়া যৌন সম্পর্ককে ‘অতি গর্হিত অপরাধ’ বলে গণ্য করা হয়। এখানে এ ধরনের ঘটনার শিকার হওয়ার পর একজন নারীর সামাজিকভাবে অপদস্থ হওয়ার নজিরও বিরল নয়।
অন্যদিকে ক্রিকেটার রুবেল দাবি করেন, তাঁকে ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছে। এ ঘটনার কিছুদিন পরে রুবেল ছাড়া পেয়ে বিশ্বকাপ খেলতে চলে যান। সেখান থেকে ফিরে আসার পর আদালত তাঁর অপরাধের কোনো অকাট্য প্রমাণ খুঁজে পাননি বলে জানায়।
এরপর অনেক তর্ক-বিতর্ক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সারাদেশে কুৎসা রটনার পর একদিন হঠাৎই হ্যাপী ঘোষণা দেন, তিনি রুবেলকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।
অতীত মুছে দেওয়া
রুবেলের ঘটনার পর অনেক দিন লোকচক্ষুর বাইরে ছিলেন হ্যাপী। এরপর যখন সামনে এলেন, সবার চক্ষু চড়কগাছ। চলচ্চিত্র জগতের পোশাকের গণ্ডি ছাড়িয়ে হ্যাপী যে একেবারে বোরখায় আবৃত! এরপরই তাঁর জীবন সম্পর্কে জানার আগ্রহ বাড়ে পাঠকের।
রুবেলের সঙ্গে স্ক্যান্ডালের পর হ্যাপী বদলে গেছেন পুরোপুরিই। অর্ধেক কাজ করার পর ছেড়ে দিয়েছেন চলচ্চিত্র। দাবি করেছেন, ‘দৈববাণী’ পেয়ে তিনি তাঁর জীবন নতুন করে সাজাতে শুরু করেন।
এরপর সুন্নি মুসলমানদের ধর্মপ্রচার আন্দোলন ‘তাবলিগ জামাত’-এ যোগ দেন হ্যাপী। আর আগের জীবনের সব বন্ধন ছিন্ন করতে আরম্ভ করেন।
‘হ্যাপী থেকে আমাতুল্লাহ’ বইয়ে হ্যাপীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন সাদেকা সুলতানা সাকি। বইটির সহলেখক সাকির স্বামী আবদুল্লাহ আল ফারুক বলেন, ‘এক রাতে হ্যাপী ফেসবুকে তাঁর পোস্ট করা হাজার হাজার ছবি মুছে দেওয়া শুরু করেন। এরপর তিনি চলচ্চিত্রজগতের সঙ্গে তাঁর সব সম্পর্ক ছিন্ন করেন।’
‘এরপর তিনি তাঁর নামকরণ করেন আমাতুল্লাহ বা আল্লাহর দাসী। নিজেকে আবৃত করেন বোরখায়। এখন তিনি বাইরে বেরোলে তাঁর হাত ও পায়ের গোড়ালিও মোজায় ঢাকা থাকে’, জানান আবদুল্লাহ আল ফারুক।
হাজারো ভক্ত আর চলচ্চিত্রের দুনিয়াকে পেছনে ফেলে হ্যাপী চলে এসেছেন কঠোর সংযমের জীবনে। একটি মাদ্রাসায় কোরআন পড়তে শুরু করেছেন। তাঁর ভাষ্য, ‘এখন কেউ আমার আঙুলের নখটি পর্যন্ত দেখতে পাবে না।’
হ্যাপী জানান, তিনি তাঁর অতীত মুছে ফেলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। প্রতিজ্ঞায় অবিচল হ্যাপী এমনকি তাঁর শেষ করা চলচ্চিত্র ‘আসল মানুষ’ প্রচার না করতে ওই চলচ্চিত্রের সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করেছেন।