যে কারণে অভিযোগপত্রে হাসনাত করিমের নাম নেই
গুলশানের রেস্তোরাঁ হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলার অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমের নাম।
হামলার পরিকল্পনায় এবং এমনকি গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের বর্ণনায় কোথাও হাসনাত করিমের সম্পৃক্ততা প্রমাণিত না হওয়ায় তাঁকে মামলা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
আজ সোমবার আদালতে এ মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এরপর দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম।
মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘নব্য জেএমবির একটি সাংগঠনিক পরিকল্পনায় এ হামলা করা হয়েছে। তাদের এ পরিকল্পনার কোথাও হাসনাত করিমের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া যারা জীবিত গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের কথায়ও হাসনাত করিমের নাম আসেনি। সুতরাং চার্জশিট দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষদর্শী যারা ছিল তাদের জবানবন্দির ওপর ডিপেন্ড (নির্ভর) করা হয়েছে এবং চার্জশিটে আদালতকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।’
হামলার পর প্রকাশিত একটি ছবিতে জঙ্গিদের সঙ্গে হাসনাত করিমকে দেখে তাঁকে এ হামলায় সম্পৃক্ত ভাবা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘সেই ছবিগুলো আমরা বিশ্লেষণ করেছি। সেই বিশ্লেষণের ফলাফলও আদালতে ব্যাখ্যা করেছি।’
মনিরুল আরো বলেন, ‘হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলার এজাহারে আসামির কলামে কারো নাম ছিল না। এজাহারের বডিতে হাসনাত করিমের নাম ছিল। আর্টিজান থেকে যাদের জীবিত উদ্ধার করা হয়, এমন ১৭ জন এবং যেই ছয় আসামিকে জীবিত উদ্ধার করে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, তারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দি ও আলামত যাচাই করে যাদের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত হওয়া গেছে চার্জশিটে তাদের নামই দেওয়া হয়েছে।’
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট প্রধান মনিরুল ইসলাম জানান, প্রায় পাঁচ মাস আগে থেকেই এই হামলার পরিকল্পনা করছিলেন হামলাকারীরা। তিনি বলেন, ‘এই ঘটনায় যারা সরাসরি অংশ নিয়েছিল, যে পাঁচজন টেরোরিস্ট, তারা ঘটনাস্থলেই আমাদের অভিযান চলাকালে নিহত হয়। বাকি আটজন বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়েছে। আর আটজন আসামি জীবিত রয়েছে, যাদের ভেতরে ছয়জনকে আমরা গ্রেপ্তার করতে পেরেছি। দুইজন আসামি এখন পর্যন্ত আমরা গ্রেপ্তার করতে পারিনি। তারা এই ঘটনার মাধ্যমে সরকারকে কোণঠাসা করে দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে সরকার যাতে চাপের মুখে পড়ে, দেশ অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়। সরকার যখন আসল জঙ্গিদের ধরতে না পেরে অন্যান্য সাধারণ নাগরিকের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন করে মানুষকে অতিষ্ট করে তোলে, যাতে জঙ্গিরা তাদেরকে রিক্রুট করতে পারে। পাশাপাশি, সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে তাদেরকে কাজে লাগাতে পারে। এই উদ্দেশ্যেই তারা অ্যাটাক করেছে।’
মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকা ছয় আসামি হলেন জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, রাশেদুল ইসলাম ওরফে র্যাশ, সোহেল মাহফুজ, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান এবং হাদিসুর রহমান সাগর। এছাড়া পলাতক দুই আসামি হলেন- শহীদুল ইসলাম খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন। তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আবেদন করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা।
মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাত পৌনে ৯টার দিকে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায় বন্দুকধারীরা। হামলার পর রাতেই তারা ২০ জনকে হত্যা করে।
সেদিনই উদ্ধার অভিযানের সময় বন্দুকধারীদের বোমার আঘাতে নিহত হন পুলিশের দুই কর্মকর্তা। পরদিন সকালে সেনা কমান্ডোদের অভিযানে নিহত হয় পাঁচ হামলাকারী। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরেকজনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় গুলশান থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়ের করে পুলিশ।
জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) এ হামলার দায় স্বীকার করে। সংগঠনটির মুখপাত্র ‘আমাক’ হামলাকারীদের ছবি প্রকাশ করে বলে জানায় জঙ্গি তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স।’
হামলার পরদিন সকালে উদ্ধারকৃত জিম্মিদের মধ্যে রহস্যজনক আচরণের কারণে হাসনাত করিমকে গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
একজন কোরিয়ান নাগরিকের গোপনে ধারণ করা ভিডিও প্রকাশিত হওয়ার পর হামলায় হাসনাত করিমের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলতে থাকে। ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষকের নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল বলেও অভিযোগ ওঠে এ সময়।
পরে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের একটি মামলায় ওই বছরের ৩ আগস্ট হাসনাত করিমকে ৫৪ ধারায় সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়। ৪ আগস্ট প্রথম দফায় হাসনাতের আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। ১৩ আগস্ট গুলশান হামলার মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ২৪ আগস্ট হাসনাত করিমের জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। তিনি বর্তমানে কাশিমপুর কারাগারে রয়েছেন।