সোমবার রফিক আজাদকে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা
আধুনকি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় কবি ও মুক্তিযোদ্ধা রফিক আজাদের মরদেহ জাতির শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আগামী সোমবার সকাল ১০টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হবে।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ জানিয়েছেন, জোটের উদ্যোগে অয়োজন করা হবে কবি রফিক আজাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠান। পরে বাদ জোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁর লাশ দাফন করা হবে।
কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী জানান, রফিক আজাদের দুই ছেলে অভিন্ন আজাদ ও অব্যয় আজাদ কানাডায় থাকেন। তাঁরা বাবাকে দেখতে দেশে এসেছিলেন। অভিন্ন আজাদ বাবাকে দেখে ১০ মার্চ কানাডায় চলে যান। আজ তিনি বাবার মৃত্যুর খবর শুনেছেন। দেশের উদ্দেশে তিনি আবার রওনা দিয়েছেন, সোমবার ঢাকায় পৌঁছানোর কথা। এর পরই রফিক আজাদের দাফন সম্পন্ন করা হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অধ্যাপক ও কবি হারিসুল হক জানান, রফিক আজাদ ৫৮ দিন লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে তাঁর রক্তচাপ পাওয়া যাচ্ছিল না। এতে ক্রমান্বয়ে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। আজ দুপুরে তীব্র রক্ত সংক্রমণজনিত কারণে ২টা ১০ মিনিটে তাঁর মৃত্যু হয়।
কবি দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুস ও কিডনিসহ নানা দুরারোগ্য ব্যধিতে ভুগছিলেন। তাঁর মরদেহ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিইউ থেকে হিমঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, গত ১৫ জানুয়ারি কবি মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত রোগে আক্রান্ত হলে প্রথমে তাঁকে বারডেম হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পরে বিএসএমএমইউতে তাঁকে ভর্তি করা হয়। বেশ কিছুদিন চিকিৎসার পর গত ১৩ ফেব্রুয়ারি কবির অবস্থার আরো অবনতি হলে তাঁকে আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। দিনে দিনে তাঁর অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। বহুমুখী শারীরিক জটিলতাও দেখা দেয়।
বিএসএমএমইউতে কবি আইসিইউ ইনচার্জ দেবব্রত বণিক ও কামরুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন ছিলেন বলে বার্তা সংস্থা বাসসের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
রফিক আজাদের বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। তিনি স্ত্রী, পাঁচ সন্তান, আত্মীয়স্বজনসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তাঁর মৃত্যু সংবাদ রাজধানীতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। তাঁকে একনজর দেখার জন্য শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ব্যক্তিত্বরা ছাড়াও সর্বস্তরের মানুষ হাসপাতালে ছুটে যান।
কবি রফিক আজাদের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পিকার ও সিপিএ নির্বাহী কমিটির চেয়ারপারসন ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বী মিয়া, চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক গভীর শোক প্রকাশ এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
রফিক আজাদ ১৯৪১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানার গুণী গ্রামের জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সলিম উদ্দিন খান একজন সমাজসেবক এবং মা রাবেয়া খান ছিলেন গৃহিণী। তিন ভাই্ ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। তাঁর জন্মের আগে মারা যান সবার বড় ভাই মাওলা ও বোন খুকি। রফিক আজাদ যখন মায়ের গর্ভে তখন তাঁর অকাল প্রয়াত বড় বোন খুকি অনাগত ছোট ভাইয়ের নাম ‘জীবন’ রেখেছিলেন। ‘জীবন’ রফিক আজাদেরই আরেক নাম।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি অভিভাবকদের শাসন উপেক্ষা করে রফিক আজাদ ভাষা শহীদদের স্মরণে প্রভাতফেরিতে অংশগ্রহণ করেন। চিরদিনই প্রতিবাদী এ কবি তাঁর দ্রোহকে শুধু কবিতার লেখনীতে আবদ্ধ না রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন লড়াইয়ে, জাতির চরম ক্রান্তিকালে, ১৯৭১ এ হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণের সৈনিক হিসেবে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছেন।
রফিক আজাদ ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি টাঙ্গাইলের মওলানা মুহম্মদ আলী কলেজের বাংলার লেকচারার ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে কাদের সিদ্দিকীর সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমিতে ‘উত্তরাধিকার’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশন, বিরিশিরি উপজাতীয় কালচালার একাডেমি এবং জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সাপ্তাহিক ‘রোববার’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেও কাজ করেছেন।
কবি রফিক আজাদ ভাষা ও সাহিত্যকর্মে অবদানের জন্য ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ২০১৩ সালে রাষ্ট্রীয় একুশে পদক অর্জন করেন। এ ছাড়া হুমায়ুন কবীর স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৭), কবিতালাপ পুরস্কার (১৯৭৯), আলাওল পুরস্কার (১৯৮১), ব্যাংক পুরস্কার (১৯৮২), সুহৃদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৯), কবি আহসান হাবীব পুরস্কার (১৯৯১), কবি হাসান হাফিজুর রহমান পুরস্কার (১৯৯৬) এবং ১৯৯৭ সালে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা লাভ করেন।
রফিক আজাদের প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে আছে- অসম্ভবের পায়ে (১৯৭৩), সীমাবদ্ধ জলে সীমিত সবুজে (১৯৭৪), নির্বাচিত কবিতা (১৯৭৫), চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া (১৯৭৭) প্রভৃতি। রফিক আজাদের প্রেমের কবিতার মধ্যে নারীপ্রেমের একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায়।
রফিক আজাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অকাল প্রয়াত মেধাবী ছাত্রী নভেরা দীপিকার বাবা।