ক্ষতিপূরণ আইন বদলাতে হবে
সাভারে রানা প্লাজায় হাজার প্রাণ হত্যার বিচার আজ পর্যন্ত সম্পন্ন হয়নি। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা বিচারহীনতার পথকেই প্রশস্ত করছে, দায়সারা অভিযোগপত্র নিয়েও রয়েছে অনেক প্রশ্ন। অভিযোগপত্র অনুযায়ী ৪১ জন আসামির মধ্যে ১৮ জন জামিনে আর ১২ জন পুলিশের চোখে পলাতক। এ ছাড়া ক্ষতিপূরণ আইন বদলানোও প্রয়োজন।
রানা প্লাজা ধসের তিন বছর উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলা হয়। রাজধানীর হাতিরপুলে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয় বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক জুলহাসনাইন বাবু। সংবাদ সম্মেলনে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি এবং ক্ষতিপূরণ আইন বাতিলের দাবি জানানো হয়।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ধসে পড়েছিল রানা প্লাজা। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এ ধসে নিহত হয়েছিলেন ১১৭৫ জনেরও বেশি শ্রমিক, যার মধ্যে ১৬২ জনের কোনো খোঁজই পাওয়া যায়নি।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ‘সোহেল রানাসহ ১১ জন আছে কারাগারে। আমরা দাবি করছি, অবিলম্বে সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে এবং দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আমরা এসব ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই এবং অবিলম্বে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানাই।’
‘ক্ষতিপূরণ আইন বদলাতে হবে’
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ‘আমরা আশা করেছিলাম ক্ষতিপূরণের আইন বদল হবে। এত বড় ঘটনার পরও বদল হয়নি ক্ষতিপূরণের আইন। বিদেশি ক্রেতাদের দানে অনুদান দেওয়া হয়েছে রানা প্লাজা ও তাজরীনের শ্রমিকদের, যেটি কোনোভাবেই ক্ষতিপূরণ নয়। ক্ষতিপূরণ শ্রমিকের আইনি অধিকার। কিন্তু অনুদান বা সহায়তার ওপর কোনো আইনি অধিকার শ্রমিকদের নেই। বরং দীর্ঘমেয়াদে এই ধরনের অনুদান, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার নানামাত্রায় দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক প্রকল্প, সহায়তা ও প্রশিক্ষণ ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে পরনির্ভশীলতা ও ভিক্ষাবৃত্তির মনোভাব তৈরি করেছে। অনুদানের তারতম্য শ্রমিকদের মধ্যে বৈষম্যও তৈরি করেছে।’
‘কেউ কেউ এখনো ক্ষতিপূরণ পায়নি এমন অভিযোগও আছে। অনুদান বা ভিক্ষা নয় বরং ক্ষতিপূরণ শ্রমিকের আইনি অধিকার। শ্রম আইন অনুযায়ী, ক্ষতিপূরণের যে মানদণ্ড (১ লাখ আর ১ লাখ ২৫ হাজার) সেটি কোনো ক্ষতিপূরণ হতে পারে না। আর অনুদান বা আর্থিক সহায়তা হিসেবে যে অর্থ ক্ষতিগ্রস্তরা পেয়েছেন, আইন বদল না হওয়ার কারণে অন্য কারখানায় এ ধরনের ঘটনা ঘটলে সেই শ্রমিকরা রানা প্লাজার মতো সহায়তা পাবেন না। আইনের বদল এবং আইনি অধিকারই শ্রমিকের ক্ষতিপূণের অধিকার নিশ্চিত করতে পারে। আমরা ক্ষতিপুরণের আইন বদলের দাবি করি, দাবি করি শ্রমিকের এক জীবনের সমান ক্ষতিপূরণ।’
‘শ্রমিকের জীবনের মূল্য নেই’
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ‘রানা প্লাজা ধসের পর আমরা আশা করেছিলাম, সরকার উদ্যোগ নিয়ে রানা প্লাজা তাজরীনের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধে উদ্যোগ নেবে। কিন্তু আমরা অত্যন্ত ক্ষোভ ও দুঃখের সাথে লক্ষ করলাম এখনো দোষীরা আইনের আওতায় শাস্তি ভোগ করেনি। যেটি দৃষ্টান্ত হিসেবে অন্য কারখানায় এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তির সুযোগকেই প্রশস্ত করে। দোষীরা শাস্তি পেলে অন্য কারখানার মালিক, সরকারি কর্মকর্তা এবং বিদেশি বায়াররা আরো সতর্ক হতো। কিন্তু দোষীদের শাস্তি তিন বছরেও না হওয়ায় এটি প্রমাণিত হয় সরকারের কাছে এই শ্রমিকের জীবন এবং স্বপ্নের কোনো মূল্য নেই। শ্রমিকরা তাদের কাছে মুনাফা তৈরির নাট-বল্টু ছাড়া কিছুই মনে করে না। দোষীদের শাস্তির বিষয়ে দীর্ঘসূত্রতা সরকার ও বিচার ব্যবস্থার গাফিলতি এবং শ্রমিক স্বার্থের পরিপন্থী অবস্থাকেই হাজির করেছে।’
‘কালো ব্যাজ ধারণ করুন’
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ‘রানা প্লাজা ধসের ঠিক ছয় মাস আগে তাজরীন গার্মেন্টে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় ১১১ জন শ্রমিককে। ২-৩ বছরের মধ্যে এসব ঘটনা হারিয়ে গেছে স্মৃতির অতলে। মৃত শ্রমিকেরা রূপান্তরিত হয়েছেন পরিসংখ্যানে। শ্রমিকের নির্যাতনের ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে পারলে স্বার্থ রক্ষা হয় মালিকের, দায় থেকে গা বাঁচাতে পারে সরকার। কিন্তু আমরা ভুলতে চাই না। আমরা চাই, রানা প্লাজা ও তাজরীনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধ। গত তিন বছর ধরে আমরা তাই ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন করে আসছি। প্রতি মাসের ২৪ তারিখে রানা প্লাজার সামনে প্রতিবাদ জানিয়েছি আমরা। আন্দোলন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় রানা প্লাজার শ্রমিক হত্যার তিন বছরে আমরা আবারো জোরের সাথে দাবি করছি, রানা প্লাজায় স্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের, দাবি করছি ২৪ এপ্রিলকে রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক ও শ্রমিক নিরাপত্তা দিবস হিসেবে পালনের। এ কারণেই আমরা আপনাদের মাধ্যমে গার্মেন্ট শ্রমিকসহ সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আহ্বান জানাতে চাই ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ও তাজরীনের নিহত শ্রমিকদের স্মরণে কালো ব্যাজ ধারণ করুন, অন্যকেও পরতে উৎসাহিত করুন।’
এ ছাড়া সংবাদ সম্মেলনে ২৪ এপ্রিলকে শোক ও শ্রমিক নিরাপত্তা দিবস পালন, পোশাক কারখানায় ছুটি ঘোষণা, গণতান্ত্রিক শ্রম আইন প্রণয়নের দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, আগামী শুক্রবার রানা প্লাজা প্রাঙ্গণে আলোকচিত্র প্রদর্শনী ও শ্রমিক সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন সংগঠনের সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার। এ ছাড়া সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় সহসাধারণ সম্পাদক অঞ্জন দাস, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক দীপক রায়, দপ্তর সম্পাদক মুসা কলিমুল্লাহ।