নিজামী বলেছিলেন, ‘সাতক্ষীরার সাংবাদিকরা মিথ্যাবাদী’
নাগরিকত্ব লাভের পর বাংলাদেশে কোনো প্রকাশ্য জনসভায় প্রথম বক্তৃতা দিতে সাতক্ষীরা এসেছিলেন জামায়াতে ইসলামীর নেতা গোলাম আযম। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মতিউর রহমান নিজামীসহ অনেকেই। ১৯৯৪ সালের ৩০ মার্চ সাতক্ষীরার শহীদ রাজ্জাক পার্কজুড়ে জামায়াতে ইসলামী এই কর্মিসভা আহ্বান করে।
তবে ওই সমাবেশ সফল হয়নি। মানুষের বিক্ষোভের মুখে মঞ্চ ছেড়ে চলে যেতে হয় গোলাম আযমকে। পরের দিন সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়, ‘গভীর রাতে গোলাম আযমের পলায়ন’। অথচ মতিউর রহমান নিজামী জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘সাতক্ষীরায় কিছুই ঘটেনি। সেখানকার সাংবাদিকরা মিথ্যাবাদী। সেখানকার সাংবাদিকরা যা লিখেছে সবই মিথ্যা।’
ওইদিন জনতার তীব্র প্রতিরোধের মুখে গোলাম আযম ও তাঁর সহযোগীরা মঞ্চে উঠতেই উত্তেজনা দেখা দেয়। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, আওয়ামী লীগ, জাসদ, বাসদ, কমিউনিস্ট পার্টি, ওয়ার্কাস পার্টি এবং ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন সেদিন হরতালের ডাক দেয়। জনতার এই প্রতিরোধ উপেক্ষা করে সাতক্ষীরায় হাজির হয়েছিলেন গোলাম আযম। নিজামী ছাড়াও তাঁর সঙ্গে ছিলেন, আব্বাস আলী খান এবং সাতক্ষীরার জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সংসদ সদস্য কাজী শামসুর রহমান, শেখ আনসার আলী, মাওলানা রিয়াসাত আলী ও গাজী নজরুল ইসলাম।
মঞ্চের মধ্যখানে চেয়ারে উপবিষ্ট ছিলেন গোলাম আযম। এরই মধ্যে কারো বক্তৃতা শুরুর আগেই শুরু হয়ে যায় তীব্র প্রতিরোধ। সমাবেশে উপস্থিতদের কয়েকজন বলতে থাকেন, ‘হঠাও জামায়াত, তাড়াও শিবির।’সেদিন সাতক্ষীরা পরিণত হয়েছিল এক রণক্ষেত্রে। একদিকে ছিল জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির। আর এর বিপরীতে ছিল সকল রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী সহ সর্বস্তরের মানুষ। গোলাম আযম বক্তৃতা দিতে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত মঞ্চ ছেড়ে সঙ্গীদের নিয়ে সাতক্ষীরা থেকে পালাতে বাধ্য হন। আর পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল ‘গভীর রাতে গোলাম আযমের পলায়ন’।
অথচ জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী ঢাকায় পৌঁছে জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ‘সাতক্ষীরায় কিছুই ঘটেনি। সেখানকার সাংবাদিকরা যা লিখেছে সবই মিথ্যা।’
নিজামীর ওই বক্তব্যেরও প্রতিবাদ করে সাতক্ষীরার মানুষ। তারা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেয় নিজামীর বক্তব্য মিথ্যা। সেদিন রণক্ষেত্রে কমপক্ষে ২৫০ জন আহত হয়েছিল। ভাঙচুর হয়েছিল সাতক্ষীরা থানাসহ বিভিন্ন স্থাপনা। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সংসদ সদস্য কাজী শামসুর রহমানের বাড়ি।
মুক্তিযোদ্ধারা সেদিনের ঘটনাবলীর স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাকে জামায়াতে ইসলামী কর্মীরা অবমাননা করে কেষ্ট ময়রার মোড়ে বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর গুলি করতে উদ্যত হয়। এসব কর্মীরা শহীদ রাজ্জাক পার্কের ভাঙা দেওয়ালের ইট নিয়ে জনতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
মুক্তিযোদ্ধা হাসনে জাহিদ জজ বলেন, ‘জামায়াত নেতা ক্যাপ্টেন রবিউলের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা অফিস ভাঙচুর করে জামায়াত ও শিবিরের কর্মীরা। জাতীয় পতাকায় অগ্নিসংযোগ এবং জেনারেল ওসমানীসহ সাতজন বীরশ্রেষ্ঠর ছবি, মুক্তিযোদ্ধা কাজল, নাজমুল ও সিরাজুলের ছবি ভেঙেচুরে দিয়েছিল। কর্মীরা স্লোগান দিয়েছিল ‘হই হই রই রই, মুক্তিযোদ্ধারা গেল কই।’
কর্মী সমাবেশের নামে শহীদ রাজ্জাক পার্কের জামায়াতের সমাবেশ ঘিরে জেলাব্যাপী হরতাল, দিনভর উত্তেজনা, মিছিল, পিকেটিং ও কয়েক ঘণ্টাব্যাপী ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়েছিল। জামায়াত শিবিরের সমর্থকদের মোকাবিলা করতে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। আহতদের মধ্যে ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট আজিজুল ইসলাম, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আখলাক হোসেন, পৌর কমিশনার মমিনুল্লাহ মোহন, হাসনে জাহিদ জজ এবং বেশ কয়েকজন পুলিশ কনস্টেবল। জামায়াত ও শিবিরের কর্মীরা সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপিকা ফরিদা রহমানের বাড়িতে ঢুকে ভাঙচুর করে।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার ইনামুল হক বিশ্বাস বলেন, ‘বিক্ষুব্ধ জনতা সাবেক সংসদ সদস্য কাজী শামসুর রহমান ও জেলা রেজিস্ট্রার আবদুর রাজ্জাকের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ১৯৯৪ সালের এসব তাণ্ডবের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা আরো বলেন, ‘গোলাম আযম ও তাঁর সহযোগীরা সাতক্ষীরায় জনসভা করতে ব্যর্থ হয়ে যশোরের কেশবপুর এবং খুলনায় সুধী বৈঠকের কর্মসূচি বাতিল করে গভীর রাতে সাতক্ষীরা থেকে পালিয়ে যান। অথচ এসব ঘটনাকে মতিউর রহমান নিজামী সাংবাদিকদের মিথ্যাচার বলে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন বলে উল্লেখ করেন তাঁরা।’
৩০ মার্চের এই তাণ্ডবের পর ৩১ মার্চ ও ৫ এপ্রিল সাতক্ষীরায় মুক্তিযোদ্ধা জনতা প্রতিবাদ সমাবেশ করে জামায়াতের তাণ্ডব ও নিজামীর মিথ্যাচারের বিচার দাবি করে। এতে যোগ দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি সৈয়দ কামাল বখত সাকি, মুনসুর আহমেদ, জাতীয় পার্টির অ্যাডভোকেট আবদুর রউফ, এ এফ এম এন্তাজ আলী, স ম আলাউদ্দিন, বিএনপির শামসুল হক ও কামরুল ইসলাম ফারুক, ওয়ার্কার্স পার্টির মুস্তফা লুৎফুল্লাহ, সাংবাদিক আনিসুর রহিমসহ অনেকেই।