বায়োফার্মার অনিয়ম অনুসন্ধানে হাইকোর্টের আদেশ আপিলে বহাল
ওষুধ কোম্পানি বায়োফার্মা লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান করতে হাইকোর্টের দেওয়া আদেশ বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে বায়োফার্মা লিমিটেডের পক্ষে করা লিভ টু আপিল (আপিল করার অনুমতি চেয়ে আবেদন) খারিজ করে আজ সোমবার (২৪ জুলাই) প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
একইসঙ্গে এ সংক্রান্ত রুল দুই মাসের মধ্যে হাইকোর্টে নিষ্পত্তি করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
‘দেশে দেশে পাচার বায়োফার্মার টাকা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় একটি জাতীয় পত্রিকায়। ওই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ২৪ মে হাইকোর্ট রুলসহ অনুসন্ধানের আদেশ দেন। অভিযোগ অনুসন্ধান করার দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেন।
একইসঙ্গে রিট আবেদকারী ওই কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার ডা. মোর্শেদ উদ্দিন আকন্দ এবং ডা. জাহাঙ্গীর আলমকে বরখাস্তের বিষয়ে দেওয়া আবেদন নিষ্পত্তির নির্দেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি দুর্নীতি ও অর্থ-পাচারের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বিবাদীদের ব্যর্থতা এবং নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়।
স্বাস্থ্যসচিব, অর্থসচিব, দুদক চেয়ারম্যান, এনবিআরের চেয়ারম্যান, বিএফআইইউ, বায়োফার্মা লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ বিবাদীদের চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। পরবর্তী আদেশের জন্য ৩০ জুলাই হাইকোর্টে দিন ধার্য রয়েছে।
হাইকোর্টের এই আদেশ স্থগিত চেয়ে বায়োফার্মা লিমিটেডের পক্ষে কোম্পানির ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ারুল আজীম আপিল বিভাগে আবেদন করেন, যা ১২ জুলাই আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে শুনানির জন্য ওঠে। সেদিন চেম্বার আদালত বায়োফার্মা লিমিটেডের পক্ষে করা লিভ টু আপিলটি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠান। এর ধারাবাহিকতায় বিষয়টি আজ আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় ওঠে।
আদালতে বায়োফার্মা লিমিটেডের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী তানজিব উল আলম। রিট আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আবদুস সালাম মামুন।
আইনজীবী আবদুস সালাম মামুন বলেন, ‘বায়োফার্মা লিমিটেডের পক্ষে করা লিভ টু আপিল খারিজ করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। এ সংক্রান্ত রুল দুমাসের মধ্যে হাইকোর্টে নিষ্পত্তি করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হাইকোর্টের আদেশ স্থগিতাদেশ দেননি আপিল বিভাগ। ফলে, অভিযোগ অনুসন্ধান করতে হাইকোর্ট যে আদেশ দিয়েছেন, তা বহাল রইল।’
এর আগে, গত ১৮ এপ্রিল ‘দেশে দেশে পাচার বায়োফার্মার টাকা’ শিরোনামে ওই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, দেশে মন্ত্রী, এমপি, রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের সঙ্গে দহরম-মহরম সম্পর্ক। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তোলা হাস্যোজ্জ্বল ছবি দেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও। কিন্তু, লন্ডনে স্ত্রীর জন্য চেয়েছেন রাজনৈতিক আশ্রয়। শুধু তাই নয়, লন্ডনে কোম্পানি খুলে ব্যবসাও করছেন। কয়েকটি দেশে তৈরি করেছেন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের জন্য দেশ থেকে অবৈধ চ্যানেলে নেওয়া হয়েছে বিপুল অঙ্কের টাকা।
বিদেশে টাকা পাচার করে বিত্ত-বৈভবে ফুলে ফেঁপে উঠলেও যেই কোম্পানির হাত ধরে এত কিছু, সেই প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে রুগ্ন দশায়। গত ১৫ বছরেও শেয়ারহোল্ডারদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়নি বার্ষিক সাধারণ সভা। ২২ বছর ধরে দেওয়া হয় না কোনো লভ্যাংশ। এ সময়ে মোট পণ্য বিক্রির ৪০ শতাংশ কম দেখিয়ে শত শত কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন। কোম্পানির অভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে এসব অনিয়মের চিত্র।
এমন নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত প্রতিষ্ঠানটি হলো বায়োফার্মা লিমিটেড। ওষুধ শিল্পে একসময়ে নেতৃত্ব দেওয়া এ প্রতিষ্ঠানটি এখন টিকে থাকার লড়াইয়ে। ধারাবাহিক অনিয়মে প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংসের মূল কারিগর উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ডা. লকিয়ত উল্লাহ। কাগজে-কলমে ডিএমডি হলেও তিনিই প্রতিষ্ঠানটির সর্বেসর্বা।
১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বায়োফার্মা লিমিটেড’ নামের ওষুধ কোম্পানিটি। ১৯৯৯ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল থেকে পাস করা কয়েকজন চিকিৎসক কিনে নেন প্রতিষ্ঠানটি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোম্পানিটি নতুনভাবে যাদের হাত ধরে যাত্রা শুরু হয়, তাদের বেশিরভাগই জামায়াতের নেতাকর্মী। পরে, এটিকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়। সাধারণ শেয়ারহোল্ডার হিসেবে যাদের নেওয়া হয়, তাদের বেশিরভাগই উদ্যোক্তাদের ‘নিজের লোক’।
বায়োফার্মার নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, নতুনভাবে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কোম্পানির বতর্মান ৯ পরিচালক ঘুরে ফিরে আছেন পরিচালনা পরিষদে। সাবেক চেয়ারম্যান এন এ কামরুল হাসানের বিরুদ্ধে বেশকিছু সরকারবিরোধী মামলা রয়েছে। তিনি ২০১৯ সালে পালিয়ে স্থায়ীভাবে আমেরিকা চলে যান। এরপরও রয়ে গেছেন উপদেষ্টা হিসেবে।
বর্তমানে চেয়ারম্যান পদে আছেন শেয়ারহোল্ডার নাছিমা বেগম ঝুমুর। প্রতিনিধি হিসেবে আসছেন তার স্বামী ডা. শাহাবুদ্দিন আহমদ। ১৮ বছরের সাবেক এমডি ডা. আনোয়ারুল আজিম এখন ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্বে। আর ডিএমডি ডা. লকিয়ত উল্লাহ শুরুতে ছিলেন নির্বাহী পরিচালক (মার্কেটিং)। তারা তিনজনই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে আছেন ডা. মো. মিজানুর রহমান। তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন।
অন্য পরিচালকরা হলেন ডা. জহির উদ্দিন মাহমুদ, ডা. আলী আশরাফ খান, শেয়ারহোল্ডার নাজমা হকের প্রতিনিধি ও তার স্বামী ডা. ফজলুল হক মজুমদার এবং সাইফুল আমিন। তারা প্রত্যেকেই জামায়াতের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্বে রয়েছেন। তাদের মধ্যে আলী আশরাফ নারায়ণগঞ্জ থেকে জামায়াতের হয়ে সংসদ নির্বাচনও করেছিলেন। জামায়াত সমর্থিত ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড বিজনেসম্যান ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের (আইবিডব্লিউএফ) মহাসচিবের দায়িত্বে আছেন বায়োফার্মার ভাইস চেয়ারম্যান ডা. আনোয়ারুল আজিম। কোম্পানি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোম্পানির নেতৃত্বস্থানীয় প্রায় সবাই শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং বিভিন্ন পদে দায়িত্বও পালন করেছেন।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে নিজেদের আড়াল করা শুরু করে কোম্পানির নেতৃত্বস্থানীয়রা। বন্ধ করা হয় বার্ষিক সাধারণ সভা। গোপনে সম্পন্ন করা হতো কোম্পানি সংশ্লিষ্ট সব আইনি কর্মকাণ্ড। এমনকি জামায়াতের নেতাকর্মীদের মামলার খরচের টাকার জোগানও দেওয়া শুরু হয় কোম্পানি থেকে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে গঠিত ফান্ডেও টাকা দেওয়া হয়। এসব টাকা দেওয়ার নথিও গোপনে বিভিন্ন খাত দেখিয়ে লিপিবদ্ধ করা হয় কোম্পানির হিসাবে। প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরীণ তদন্তেই এমন চাঞ্চল্যকর সব তথ্য উঠে আসে।
প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং শেয়ারহোল্ডারা জানান, বায়োফার্মা গঠনের পর থেকে লভ্যাংশ বিতরণ করা হয়নি। বলা হতো, লাভের টাকাগুলো কোম্পানির উন্নয়নে খরচ করা হচ্ছে। এসবের নথি কখনো প্রকাশ করা হয়নি। ২০০৮ সালের পর থেকে সরকারের রোষানলে পড়ার ভয় দেখিয়ে প্রকাশ্যে বার্ষিক সাধারণ সভাও বন্ধ করা হয়।
কাগজপত্রে সীমাবদ্ধ ছিল নানা আইনি কাজ। শুরু হয় অন্যত্র টাকা পাচার। হঠাৎ করে ২০০৯ সালে কোম্পানির সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে একে একে প্রায় ১২টি কাগুজে কোম্পানি করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠান অনেকটা অস্তিত্বহীন। এগুলোর সঙ্গে অস্বাভাবিক লেনদেন চিহ্নিত করেছে তদন্ত কমিটি। বিশেষ করে ‘বায়োফার্মা ফাউন্ডেশন’ ও ‘গোল্ড ট্রেডিং কোম্পানি’ সহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে বায়োফার্মার হিসাব থেকে স্থানান্তর করা হয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা।
জানা যায়, কয়েকজন শেয়ারহোল্ডারের তীব্র প্রতিবাদের মুখে ২০১৯ সালের ১৯ অক্টোবর রাজধানীর একটি পাঁচতারা হোটেলে কোম্পানির গ্রুপ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে ব্যবসা উন্নয়ন সভা আহ্বান করা হয়। সেখানে উপস্থিত প্রতিনিধিদের দাবির মুখে সব অনিয়ম তদন্তে একাধিক কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিগুলো ২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সর্বশেষ ৪০৫ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।
পাঁচ তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোম্পানির প্রায় ৫০০ কোটি টাকা অনিয়ম, আত্মসাৎ ও পাচার হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২০০ কোটি টাকা গেছে জামায়াতের বিভিন্ন মামলা মোকাবিলা ও যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর কর্মকাণ্ডে।
ডা. লকিয়ত উল্লাহর জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধী কানেকশনসহ নানা অনিয়ম নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন কোম্পানির অন্যতম শেয়ারহোল্ডার চট্টগ্রামের পূর্ব মাদারবাড়ির বাসিন্দা মোহাম্মদ ফরিদউদ্দিন কাউসার খান।
কোম্পানি গঠনের ২২ বছর ধরে লভ্যাংশ বিতরণ করা হয়নি উল্লেখ করে তিনি লিখেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসায় ২০০৮ সাল থেকে কোম্পানির এজিএম করা হয়নি। আমাদের বলা হয়েছিল, তখন এজিএম করলে জামায়াত কানেকশনের অভিযোগে কোম্পানি হাতছাড়া হতে পারে। পরে দেখা যায়, পরিচালনা পরিষদ বিশেষ করে লকিয়ত নানা কারসাজি করে কোম্পানির বিপুল পরিমাণ টাকা অন্যত্র পাচার করে দেন। এর পরিমাণ প্রায় ৫০০ কোটি টাকা, যা পরে অভ্যন্তরীণ তদন্তেও ধরা পড়ে। এই প্রদিবেদনের ভিত্তিতে হাইকোর্টে রিট করেন ডা. মোর্শেদ উদ্দিন আকন্দ এবং ডা. জাহাঙ্গীর আলম।