চট্টগ্রামে বন্যায় ১৩৫ কোটি টাকার ক্ষতি, পানির নিচে ২৭ হাজার হেক্টর জমির ফসল
টানা এক সপ্তাহের ভারি বৃষ্টি ও নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় চট্টগ্রামে প্রাথমিকভাবে ১৩৫ কোটি ১৫ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার (১০ আগস্ট) চট্টগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নগরের পাঁচলাইশ, ডবলমুরিং ও পতেঙ্গা এলাকা এবং জেলার ১৪ উপজেলায় পাঁচ হাজার ৬৭ হেক্টর জমিতে আবাদ হওয়া শরৎকালীন সবজিসহ চট্টগ্রামে বন্যার পানির নিচে তলিয়ে গেছে প্রায় ২৭ হাজার হেক্টর জমির ফসল। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সবজি ক্ষেতের। বৈরি আবহাওয়া ও পানির নিচে তলিয়ে গিয়ে সবজির শতভাগ ক্ষতি হয়েছে। বন্যার পানিতে ডুবে চট্টগ্রামে ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। ধসে পড়েছে শত শত ঘরবাড়ি।
গত ১ আগস্ট থেকে চট্টগ্রামে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। ৪ আগস্ট নগরী ও জেলায় বন্যা দেখা দেয়। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি অবনতি হতে থাকে। এর মধ্যে ৭ আগস্ট পর্যন্ত চার দিন টানা জলাবদ্ধতা ছিল নগরীতে।
গত এক সপ্তাহে চট্টগ্রামে ৬৬৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, যা বিগত ৩০ বছরের মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে। অতি বৃষ্টির সাথে যোগ হয়েছে পাহাড়ি ঢল। পাহাড়ি নদী সাঙ্গু, মাতামুহুরী ডলু এবং কর্ণফুলী ও হালদার পানি বেড়েছে প্রতিদিন।
অপরদিকে, জেলার ১৫ উপজেলার মধ্যে ১৪টি উপজেলায় এখনও কিছু কিছু এলাকায় বন্যায় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে মানুষকে। জেলার সাতকানিয়া, চন্দনাইশ, লোহাগাড়া, ফটিকছড়ি ও হাটহাজারী উপজেলায় এখনও হাজার হাজার বাড়িঘর পানির নিচে ডুবে ছিল। সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও চন্দনাইশ উপজেলায়।
চট্টগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. সাইফুল্লাহ মজুমদার বলেন, ‘বন্যায় চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায় ১৫ জন পানিতে ভেসে মারা গেছেন। এর মধ্যে সাতকানিয়ায় ছয়, লোহাগাড়ায় চার, চন্দনাইশে দুই, রাউজানে এক, বাঁশখালীতে এক ও মহানগরীতে একজন মারা গেছেন। প্রাথমিকভাবে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩৫ কোটি টাকা।’ তিনি বলেন, ‘জেলার সন্দ্বীপ ছাড়া বাকি ১৪ উপজেলায় কমবেশি বন্যা দেখা দিয়েছে। পানিবন্দি মানুষের জন্য শুকনো খাবার দেওয়া হয়েছে। দেওয়া হয়েছে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেটসহ প্রয়োজনীয় ত্রাণ সামগ্রী।’
সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিল্টন বিশ্বাস জানান, বন্যায় সাতকানিয়ায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, এখন পানি নামছে। অনেক কাঁচা ও সেমিপাকা ঘর ধসে পড়েছে। রাস্তাঘাট, কৃষি, মৎস্য, গবাদিপশুর অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সাতকানিয়ায় এখন পর্যন্ত বন্যায় মারা যাওয়া ছয়জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আরও তিনজন নিখোঁজ আছেন। তবে, কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা নিরূপণ করতে আরও কয়েকদিন সময় লাগতে পারে।’
লোহাগাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শরীফ উল্লাহ বলেন, ‘লোহাগাড়ায় বন্যার পানি অনেকাংশ নেমে গেছে। পানিতে ডুবে চার জন মারা গেছেন। রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কৃষি, মৎস্য, সবজি, গবাদিপশুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ৩০০ থেকে ৪০০ মাটির ঘর বন্যায় ভেঙে গেছে। ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করা হচ্ছে।’
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, ১৪টি উপজেলা এবং সিটি করপোরেশনের মধ্যে এক লাখ ৪০ হাজার ১২টি পারিবারের ছয় লাখ ৩৫ হাজার ১৩০ জন লোক বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়েন। এর মধ্যে মীরসরাই উপজেলার চারটি ইউনিয়নের পাঁচ হাজার ৯০ পরিবারের ২০ হাজার ৩৬০ জন, ফটিকছড়ির এক ইউনিয়নের ৯০ পরিবারের ৪৫০ জন, সীতাকুন্ডে ৯ ইউনিয়নের দুই হাজার ৮৬২ পরিবারের ১৫ হাজার ২৬০ জন, হাটহাজারীতে ১৫ ইউনিয়নের ৫০ হাজার পরিবারের দুই লাখ, রাউজানে ১৪ ইউনিয়নের ১৯ হাজার পরিবারের ৭৫ হাজার, রাঙ্গুনিয়ায় ১৫ ইউনিয়নের ২৫০ পরিবারের এক হাজার ২০০, বোয়ালখালীতে ছয় ইউনিয়নের ৫৫০ পরিবারের দুই হাজার ৭৫০, পটিয়ায় ১৮ ইউনিয়নের ১৬ হাজার ৫৯৫ পরিবারের ৫৩ হাজার ৩১০, কর্ণফুলী উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নের এক হাজার ৮৫০ পরিবারের ৯ হাজার ২৫০, আনোয়ারায় ১১ ইউনিয়নের এক হাজার ৪২৫ পরিবারের আট হাজার ৫০, চন্দনাইশে ১০ ইউনিয়নের পাঁচ হাজার পরিবারে ২৫ হাজার, সাতকানিয়ায় ১৭ ইউনিয়নের মধ্যে ২২ হাজার ৫০০ পরিবারে ৯০ হাজার জন, লোহাগাড়ায় ৯ ইউনিয়নের চার হাজার পরিবারের মধ্যে ৮০ হাজার, বাঁশখালীতে ১৫ ইউনিয়নের মধ্যে ১০ হাজার পরিবারের ৫০ হাজার ৫০০ ও সিটি করপোরেশনের মধ্যে ৮০০ পরিবারের চার হাজার জন পানিবন্দি ছিলেন।
এদিকে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চট্টগ্রাম মহানগরের পাঁচলাইশ, ডবলমুরিং ও পতেঙ্গা এলাকার পাঁচ হেক্টর জমিতে লাগানো আউশ ধান, ২০ হেক্টর জমিতে লাগানো আমনের চারা ও ১৪০ হেক্টর জমিতে লাগানো সবজির ক্ষেত নষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া ১৫ উপজেলায় ৩৩২ হাজার ৭১৯ হেক্টর জমিতে আউশ ধানের বীজতলা ৬ হাজার ৫৬৭ হেক্টর জমির ফসল পানির নিচে রয়েছে। এসব উপজেলায় কিছুদিন আগে ৫১ হাজার ১৩০ হেক্টর জমিতে লাগানো হয় আমনের চারা। এরমধ্যে ১৫ হাজার ৩৩০ হেক্টর জমিতে নতুন লাগানো চারার ক্ষতি হয়েছে।
আউশ ধান কাটার কথা চলতি মাসের শেষে। চট্টগ্রামের শস্যভান্ডারখ্যাত রাঙ্গুনিয়ার বৃহত্তর গুমাই বিলও এক সপ্তাহ ধরে বন্যার পানিতে ডুবে আছে। সবমিলিয়ে শরৎকালীন সবজিসহ চট্টগ্রামে বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে ২৬ হাজার ৯৬৪ হেক্টর জমির ফসল।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, এক মাস আগে চট্টগ্রাম মহানগর ও উপজেলা মিলে ৯ হাজার ৪৭০ হেক্টর জমিতে আমনের বীজতলা তৈরি করা হয়েছিল। এরমধ্যে তিন হাজার ৮৪৬ হেক্টর জমিতে লাগানো বীজতলা পানিতে ডুবে আছে। গতমাসের শেষের দিকে চট্টগ্রাম মহানগর ও উপজেলা মিলিয়ে ৫১ হাজার ১৩০ হেক্টর জমিতে লাগানো হয়েছিল আমনের চারা। ভারী বর্ষণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় বর্তমানে ১৫ হাজার ৩৩০ হেক্টর জমিতে লাগানো আমনের চারা পানিতে ডুবে গেছে। ভারি বর্ষণ ও বন্যায় চট্টগ্রামের চন্দনাইশ, বাঁশখালী, আনোয়ারা, সন্দ্বীপ ও সাতকানিয়া এলাকায় আবাদ করা আউশ ধানের বেশি ক্ষতি হয়েছে। চলতি মাসের শেষের দিকে এসব ফসল কাটার কথা ছিল।
কর্মকর্তারা আরও জানান, জলাবদ্ধতায় চট্টগ্রাম মহানগর ও উপজেলায় পাঁচ হাজার ৬৭ হেক্টর জমিতে শরৎকালীন সবজি যেমন : বেগুন, বরবটি, ঢেঁড়শ, শসা, ক্ষীরা, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, ঝিঙ্গা, কাকরোল, করলা, লাউ, চিচিঙ্গা, ধুন্দুলসহ বিভিন্ন সবজি ক্ষেত সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়েছে। আবাদ করা সবজির পুরোটাই পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক ড. অরবিন্দ কুমার রায় বলেন, ‘গত এক সপ্তাহের প্রবল বর্ষণে চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা, লোহাগাড়া, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, পটিয়া, ফটিকছড়ি ও হাটহাজারী এলাকায় বেশি ক্ষতি হয়েছে। এসব এলাকায় উৎপাদিত আউশ ধান ও সম্প্রতি লাগানো আমনের চারা পানিতে ডুবে গেছে। পাশাপাশি সবজির আবাদ পুরোটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে আশা করছি, বীজতলা থেকে পানি সরে যাওয়ার পর সেগুলোর সঠিক পরিচর্যা করলে আমনের আবাদ থেকে ভালো ফসল পাওয়া যাবে।’