আকাশ যেন ঘরের ছাউনি, রোদ-বৃষ্টি নিত্য যাদের সঙ্গী
মাথার উপরে থাকা টিনের চালাগুলো এমনভাবে ভেঙেছে, যেনো চালুনি। ঘরের চারদিকের বেষ্টনি (বেড়া) বলতেও অনেকগুলোর নেই। ফলে আকাশই যেনো তাদের ঘরের ছাউনি। তাই রোদ-বৃষ্টি, কুয়াশা তাদের প্রতিদিনের সঙ্গী।
এমন অবস্থায় কিশোরগঞ্জের ভৈরবের কালিকাপ্রসাদ ইউনিয়নের ছিদ্দিরচর ও আগানগর ইউনিয়নের নবীপুর গ্রামের আদর্শ গুচ্ছগ্রাম, আশ্রয়ণ আর আবাসন প্রকল্পে মৌলিক অধিকারবঞ্চিত অধিবাসীরা মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। সেখানকার দুই শতাধিক পরিবারের সহস্রাধিক মানুষের প্রতিদিনের দুঃখ-কষ্টের যেন কোনো প্রতিকার নেই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ভৈরব উপজেলার কালিকাপ্রসাদ ইউনিয়নের ছিদ্দিরচর বাজার এলাকায় আদর্শ গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পে ৪৭টি, আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৫০টি এবং আবাসন প্রকল্পে ২০টিসহ মোট ১১৭টি ভূমিহীন পরিবারকে পুনর্বাসিত করে সরকার। ১৯৯৭ সালে ৭ অক্টোবর আদর্শ গুচ্ছগ্রাম এবং ২০০০ সালের ১৮ নভেম্বর আশ্রয়ণ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন তৎকালীন স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান। আর ২০০২ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তত্ত্বাবধানে নির্মিত আবাসন প্রকল্প বুঝে নিয়ে অধিবাসিদের কাছে হস্তান্তর করে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন। পরবর্তীতে ২০০৪ সালে আগানগর ইউনিয়নের নবীপুর গ্রামে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ৯০টি পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়।
বিগত ২০-২৫ বছরে প্রকল্প এলাকায় তৈরি করা ঘরগুলোর উপরের চালাসহ বিভিন্ন স্থান ভেঙে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে। ফলে বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি আর শীতকালে কুয়াশার শিশির বাইরে পড়ার আগেই তাদের ঘরের ভেতর পড়ে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। এতে করে শিশু ও বৃদ্ধসহ তাদের পরিবারের সদস্যদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বৈরী আবহাওয়ায় রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। ভিজে জলে-মাটিতে একাকার হয়ে যায় তাদের আসবাবপত্র।
এ প্রকল্পে বসবাসকারী শিশুদের শিক্ষার জন্য কোনো সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়নি। ফলে শিক্ষার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত এখানকার বেশীরভাগ শিশু। তবে কিছু শিশু দূরের বিভিন্ন স্কুল-মাদ্রাসায় পড়ালেখা করে। স্বাস্থ্য সেবারও কোনো সুব্যবস্থা নেই। ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কর্মীরা কদাচিৎ আসেন মনের খেয়ালে। ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকেন এখানকার অধিবাসিরা। খাদ্য কেনার অর্থই যেখানে যোগাড় করা কঠিন, সেখানে চিকিৎসা ব্যয় কি করে মেটাবেন? পানি সরবরাহের জন্য বসানো টিউবওয়েলের প্রায় সবকটি বিকল হয়ে যাওয়ায় নদী-নালার পানি ব্যবহারে বাধ্য হচ্ছেন তারা। ফলে তাদের নানা ধরনের রোগবালাই লেগেই থাকে।
ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় টয়লেটের ময়লা-আবর্জনা উপচেপড়ে আঙিনায়। আর একটুখানি বৃষ্টি হলেই সেই নোংড়া ময়লা-পানি ঘরের ভেতর ঢুকে বাসঅযোগ্য পরিবেশ তৈরি হয়। তাছাড়া ছিদ্দিরচর এলাকায় আছে ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙন। ইতোমধ্যে অনেক ভূমি নদের পেটে চলে গেছে বলে জানান স্থানীয়রা।
এদিকে প্রকল্প এলাকায় কোনো বাউন্ডারি দেওয়াল না থাকায় এলাকার আৎকাপাড়া গ্রাম থেকে ছিদ্দিরচর বাজারগামী লোকজনসহ বিভিন্ন যানবাহন আশ্রয়ণ প্রকল্পের ভেতর দিয়ে চলাচল করে। এতে করে শিশুরা প্রায়ই দুর্ঘটনায় পড়ে। এতে নিরাপত্তাহীনতার পাশাপাশি পরিবেশ নষ্ট করছে যানবাহনের অবাধ যাতায়াত। তাছাড়া নবীপুর এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের বাড়ি-ঘরের পানি, ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখে আশ্রয়ণের অধিবাসিদের বাড়ি লাগোয়া।
প্রকল্প এলাকার অধিবাসিদের ছেলে-মেয়েদের বিয়েসহ নানা উৎসব-পার্বণের জন্য এখানে নেই কোনো ব্যবস্থা। ফলে অনেক বিড়ম্বনা নিয়ে এইসব উৎসবের আয়োজন প্রকল্প এলাকার ভেতরেই করতে হয় তাদের। ছিদ্দিরচর বা নবীপুর এলাকায় এখানকার বাসিন্দাদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি না হওয়ায় ভৈরব শহরে গিয়ে কাজ-কর্ম করতে হয়। ফলে যাতায়াতের দূরত্বে তাদের সময় ও অর্থ-দুটোই ব্যয় করতে হয়।
ভেঙে জরাজীর্ণ হয়ে পড়া ঘরগুলো দ্রুত মেরামতসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, বিশুদ্ধ পানি ও কর্মসংস্থান তৈরির ব্যবস্থার দাবি জানান এখানকার বাসিন্দারা।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ভৈরব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাদিকুর রহমান সবুজ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, খুব দ্রুত ভেঙে যাওয়া ঘরগুলো সেমিপাকা করে তৈরি করাসহ মৌলিক অধিকারের সবগুলো বিষয় সমাধান করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের নির্দেশনা পেয়ে ইতোমধ্যে প্রথমধাপে ১৮০টি ঘরের তালিকা প্রস্তুত করে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে।