আওয়ামী লীগ নয়, জিয়া-খালেদা-এরশাদ দেশ বিক্রি করেছে : প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আওয়ামী লীগ দেশ বিক্রি করে না, বরং খালেদা জিয়া, এরশাদ ও জিয়াউর রহমান সেটা করেছে। তিনি বলেন, ‘কারা দেশ বিক্রি করেছে? এটা খালেদা জিয়া, এরশাদ ও জিয়াউর রহমান করেছে। তারা দেশ বিক্রি করেছে। আওয়ামী লীগ দেশ বিক্রি করে না।’ এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী এই ত্রয়ীর শাসনামলের বেশ কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করেন, যার মধ্যে রয়েছে ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়ার দ্বারা ভারতের কাছে বাংলাদেশের গ্যাস বিক্রির জন্য মুচলেকা প্রদান।
প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা গতকাল বুধবার (৩ জুলাই) দ্বাদশ জাতীয় সংসদের তৃতীয় এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে এসব কথা বলেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন।
প্রধানমন্ত্রী তার সাম্প্রতিক ভারত সফরের সময় কিছু সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের জন্য কোনো কোনো বিরোধী রাজনৈতিক মহলের ভারতের কাছে দেশ বিক্রির অভিযোগের কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসতে পারিনি। কারণ, আমাদের গ্যাস আমেরিকান কোম্পানি উত্তোলন করছে, সেই গ্যাস তারা বিক্রি করতে চায় ভারতের কাছে। আমি সেটা আপত্তি করেছিলাম।’
শেখ হাসিনা বলেন, নির্বাচনের আগে অনেক কিছু হয়। যাই হোক, খালেদা জিয়া গ্যাস বিক্রি করতে রাজি হয়ে যায় এবং সেভাবে মুচলেকা দেয়। আমরা ভোট বেশি পেয়েছিলাম, কিন্তু সিট আর পেলাম না, সরকার গঠন করতে পারলাম না। কারণ, আমি গ্যাস বিক্রি করতে চাইনি। তো বিক্রিটা করে কে দেশকে? করে গেছে তো খালেদা জিয়া, করেছে এরশাদ, করেছে জিয়াউর রহমান, এরাই করে গেছে। আওয়ামী লীগ করে না।’
সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকে পৃথিবীটা গ্লোবাল ভিলেজ, একে অপরের ওপর ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, প্রভৃতির ওপর নির্ভরশীল। এগুলো দরজা বন্ধ করে থাকা যায় না।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের ট্রান্স-এশিয়া হাইওয়ে, ট্রান্স-এশিয়া রেলের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। আজকে ভারতকে আমরা ট্রানজিট দিলাম কেন? এটা নিয়ে নানা প্রতিক্রিয়া। আমাদের ট্রানজিট তো আছেই। ত্রিপুরা থেকে বাস চলে আসে ঢাকায়, ঢাকা হয়ে কলকাতা পর্যন্ত যাচ্ছে। এতে ক্ষতিটা কী হচ্ছে? বরং, আমরা রাস্তার ভাড়া পাচ্ছি। সুবিধা পাচ্ছে আমাদের দেশের মানুষ। অনেকে অর্থ উপার্জনও করছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সারা বিশ্বের সঙ্গে একটা যোগাযোগ হচ্ছে। আমরা নেপাল-ভুটানের সঙ্গে ট্রানজিট করেছি, ভারতের মধ্য দিয়ে। এটাতো কোনো একটা দেশ না, আঞ্চলিক ট্রানজিট সুবিধা এবং যোগাযোগ সুবিধার জন্য করা হয়েছে।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘আজকে আমরা নেপাল, ভুটান, ভারত, বাংলাদেশ—এই চারটি দেশ নিয়ে প্রত্যেকটি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা, ট্রানজিটের ব্যবস্থা। আজকে নেপাল থেকে আমরা জলবিদ্যুৎ কেনা শুরু করতে যাচ্ছি, সেখানে গ্রিড লাইন করা, আমরা সেই চুক্তি করেছি, সেটা আমরা কার্যকরও করছি। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর যেসব রেলপথ, নৌপথ যোগাযোগ বন্ধ ছিল, সেগুলো আমরা উন্মুক্ত করে দিচ্ছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভুটান থেকে একটি রাস্তা যাচ্ছে মিয়ানমার হয়ে থাইল্যান্ড পর্যন্ত। অথচ, সেই রাস্তাটা যাচ্ছে বাংলাদেশকে বাইপাস করে। যে রোড হচ্ছে তা থেকে বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন, কেন আমরা বিচ্ছিন্ন থাকব? ভারত চাচ্ছিল ভুটান থেকে এই রাস্তাটা বাংলাদেশ হয়ে, ভারত হয়ে, মিয়ানমার হয়ে থাইল্যান্ড যাবে। আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগ সবকিছু কত সুবিধা হতো। সেটাও খালেদা জিয়া নাকচ করে দিয়েছিল। এই হলো অবস্থা। আমি প্রথমবার সরকারে এসে অনেকবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমরা যুক্ত হতে পারিনি।’
ভারত থেকে পাইপ লাইনে তেল নিয়ে আসার কথা উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমরা আসামের রুমালিগড় থেকে পাইপলাইনে তেল নিয়ে এসেছি। পার্বতীপুর ডিপোতে সেই তেল আসছে। ক্ষতিটা কী হয়েছে? বরং, আমরাই কিন্তু সস্তায় কিনতে পারছি। আমাদের দেশের জন্য, ওই অঞ্চলের মানুষের চাহিদা আমরা পূরণ করতে পারি। উত্তরাঞ্চলে কোনো শিল্পায়ন হয়নি, এখন শিল্পায়নে আমরা যেতে পারি এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রও আমরা নির্মাণ করেছি।’
খালেদা জিয়া মিয়ানমার থেকে গ্যাস আনার সুযোগ নষ্ট করেছেন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কী সমস্যা দেশের জন্য করেছে দেখেন, মিয়ানমারের গ্যাস ফিল্ডের গ্যাস, ভারত, চীন, জাপান চাচ্ছে। এই গ্যাসকে বাংলাদেশের ভেতর থেকে ভারতে নিয়ে যাবে, এই নিয়ে যাওয়ার সময় এই গ্যাস থেকে আমরা একটা ভাগ নেব। তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামসহ ওই এলাকায় আমাদের গ্যাসের কোনো অভাবই হতো না। খালেদা জিয়া সেটা নিতে দেয়নি। কেন দেয়নি?’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজকে সেই গ্যাস নিচ্ছে চীন। আর কোনো দেশতো নিতে পারছে না। আমরা সরকারে আসার পর কথা বলেছিলাম মিয়ানমারের সঙ্গে, আনতে পারি কি না, কিন্তু সেটা সম্ভব না। তারা এটা অলরেডি দিয়ে দিয়েছে।’
খালেদা জিয়া দেশের তথ্য পাচার হয়ে যাবার অভিযোগে বিনামূল্যে সাবমেরিন ক্যাবলের সংযোগ পেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি বণ্টন এবং স্থলসীমান্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। কিন্তু ’৭৫সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও খালেদা জিয়া এ লক্ষ্যে কিছুই করেননি। এমনকি, নব্বইয়ের দশকে ভারত সফরে গিয়ে খালেদা জিয়া গঙ্গার পানি চুক্তির বিষয়টি উত্থাপন করতেই ভুলে গিয়েছিলেন।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকারই গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ৩০ বছরের জন্য চুক্তি করে। তিন বিঘা করিডোর উন্মুক্তসহ ভারতের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে ছিটমহল সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান করে। এটি বিশ্বে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের বাজারকে ভারতীয় পণ্যের বাজারের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিল জিয়াউর রহমান। ৪০টি পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশ অধিকার দিয়ে দেয়। ১৯৮০ সালে গ্যাস বিক্রির চুক্তিও করে আসে। ১৯৯২ সালে ভারতে গেল খালেদা জিয়া। সেখানে যৌথ ইশতেহার ঘোষণার ১১ অনুচ্ছেদে বাংলাদেশ থেকে ব্যাপক হারে ভারতে অনুপ্রবেশ করার কথা স্বীকার করে নেয়। তারপরে পুশইন শুরু হয়েছিল। সেখানে আমাদের বহু মানুষ কষ্ট পেয়েছিল। এ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহারের জন্য আমরা সংসদে দাবিও করেছিলাম, কিন্তু কর্ণপাত করা হয়নি।’
আওয়ামী লীগ সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্প অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের একটি মডেল হিসেবে বিশ্বে স্বীকৃতি পেয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এখন বাংলাদেশে ৫৮টি জেলা এবং ৪৬৪টি উপজেলায় কোনো ভূমিহীন-গৃহহীন নেই। তারা ভূমিহীন-গৃহহীন মুক্ত হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৯৭ সাল থেকে আশ্রায়ণ প্রকল্প নেওয়ার পর থেকে আমরা এ পর্যন্ত আট লাখ ৬৭ হাজার ৯৭৭টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুর্নবাসন করতে সক্ষম হয়েছি। এটা সম্ভব হয়েছে শুধু এই প্রকল্পের কারণে।’
এখনও যারা গৃহহীন ও ভূমিহীন আছে, তাদের সবাইকে বিনা পয়সায় ঘর করে দেওয়া হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘বাকি যারা আছে, তাদের আমরা ঘর করে দেবো। ভবিষ্যতে নদী ভাঙন বা দুর্যোগ-দুর্বিপাকে কেউ যদি ঘর-বাড়ি হারায় তাদেরও পুর্নবাসন করব। এটাই হচ্ছে আমাদের লক্ষ্য।’
দেশের সব নাগরিকের আবাসন নিশ্চিত করতে সবার সহযোগিতা চেয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলব। আর সেই সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনেও আমাদের এই কাজ আমরা অব্যহত রাখব। এই ক্ষেত্রে আমি সবার সহযোগিতা চাই।’
আশ্রায়ণে উপকারভোগীদের কথা তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, ‘অসহায় মানুষগুলো যখন কথা বলে, তাদের কথাগুলো যখন শুনি এটাই তো আমার বাবা চেয়েছিলেন, এটাই তো আমার বাবার স্বপ্ন ছিল, এটাই তো বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার তো হারাবার কিছু নেই। আমার একটাই লক্ষ্য, বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ, তাদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার ব্যবস্থা করে এই দেশকে আরও উন্নত করে দেবো। সেটাই আমি চাই।’
সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশংসা করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকে অনেক দোষ দেয়। আশ্রায়ণ প্রকল্পের সময় যারা একেবারে তরুণ তাদের ভেতরে যে আন্তরিকতা, তাদের কাজ করার যে আগ্রহ, সেটা সত্যিই আমাকে আশার আলো দেখায়।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এ ধরনের সম্পূর্ণ নিবেদিতপ্রাণ কর্মী দরকার। এ ধরনের অফিসার আমাদের দরকার। এই কাজটা করার সময় সেই আন্তরিকতা আমরা দেখেছি। সবাই যেন মনপ্রাণ ঢেলে দিয়ে কাজ করেছে।’
২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে সব সংসদ সদস্যের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন প্রধানমন্ত্রী।