জীবন থেকে ছুটি নিয়ে গ্রামের ফেরেন নয়ন, পারিবারিক কবরস্থানে হন দাফন
বৃহস্পতিবার সকালে ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল সোহানুর জামান নয়নের। সব প্রস্তুতি শেষ করে রাতেই ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু মধ্যরাতে পড়ে ডাক। সচিবালয়ে আগুন লেগেছে। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে ঘুম থেকে উঠে যোগ দিয়েছিলেন পেশাগত দায়িত্ব পালনে। সেখানে সচিবালয়ের আগুন নেভানোর আগেই নিভে যায় নয়নের জীবন প্রদীপ। পরে তার নিথর দেহ কফিনবন্দি হয়ে বৃহস্পতিবারই পৌঁছে তার গ্রামের বাড়িতে।
ছেলেকে হারিয়ে বুক চাপড়ে কাঁদতে থাকেন মা নার্গিস বেগম। বাবা আখতারুজ্জামান, একমাত্র বোন ও প্রতিবেশীদের আহাজারিতে রাতের নির্জনতায় নেমে আসে শোকের আবহ।
বৃহস্পতিবার (২৬ ডিসেম্বর) রাত ৯টা ৩৬ মিনিটে ঢাকা থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে রংপুরের মিঠাপুকুরে গ্রামে সীমানায় পৌঁছালে নির্জনতা ভেঙে অ্যাম্বুলেন্সের পিছু ছুটে আসে হাজারও মানুষ। তখন বাড়িজুড়ে আহাজারি আর কান্নার রোল।
ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা অ্যাম্বুলেন্স থেকে মরদেহ নামানোর পর তাকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন অনেকেই। পরে কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এরপর ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে দেওয়া হয় গার্ড অব অনার।
রাত সাড়ে ১০টার দিকে বাড়ির পাশের একটি মাঠে অনুষ্ঠিত হয় নামাজে জানাজা। এরপর বাড়ি থেকে একটু দূরে পারিবারিক কবরস্থানে জেঠাই মার (বড় আম্মা) কবরের পাশে দাফন করা হয় ফায়ার ফাইটার নয়নকে।
বুধবার দিনগত রাত ১টা ৫২ মিনিটে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন নেভানোর ইউনিটে ছিলেন নয়ন। অপারেশনাল কাজ চলানোর সময় ফায়ার ফাইটার সোয়ানুর জামান নয়ন ডেলিভারি হোজ নিয়ে সচিবালয়ের মেইন গেটের সামনে রাস্তা পারাপার হচ্ছিলেন। এ সময় গুলিস্থান জিরো পয়েন্ট থেকে কারওয়ান বাজারগামী একটি ট্রাক দ্রুত ও বেপরোয়া গতিতে ফায়ার ফাইটার নয়নকে চাপা দেয়। এতে তার মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর আঘাত লাগে। তাৎক্ষণিক বাদীসহ সহকর্মীরা উপস্থিত লোকজনের সহায়তায় নয়নকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
তার গ্রামের বাড়ি মিঠাপুকুর উপজেলার বড়বালা ইউনিয়নের ছড়ান আটপুনিয়া গ্রামে। তিনি কৃষক আখতারুজ্জামানের ছেলে।
ছোটবেলা থেকে পুলিশ বা কোনো বাহিনীতে কাজ করার স্বপ্ন ছিল। ২০২২ সালে সেই স্বপ্ন পূরণে যোগদান করেন ফায়ার সার্ভিসে।
২০১৬ সালে ছড়ান দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে নয়ন এসএসসি ও ২০১৮ সালে ছড়ান ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর ওই কলেজেই ডিগ্রি কোর্সে ভর্তি হন। এরপর ফায়ার সার্ভিসে যোগ দেন।
নয়নের মূল কর্মস্থল ছিল সিলেটের বিশ্বনাথ ফায়ার স্টেশনে। দক্ষ ও সাহসী ফায়ার ফাইটার হিসেবে অল্প সময়ের মধ্যে সবার কাছে পরিচিত হওয়ায় সেখান থেকে তাকে ঢাকার তেজগাঁও ফায়ার স্টেশনে সংযুক্ত করা হয়েছিল।
নিহত নয়নের বাবা আখতারুজ্জামান জানান, নয়নের অনেক স্বপ্ন ছিল এই চাকরিকে ঘিরে। চাকরির পাশাপাশি প্রমোশনের জন্য পড়াশোনাও চালিয়ে গিয়েছিল। মিঠাপুকুরের ছড়ান ডিগ্রি কলেজ থেকে এ বছর বিএ ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছেন। এখন ছেলে আমার ফল প্রত্যাশী ছিল। প্রমোশন পেলে বিয়ে করা ও বাড়ি গোছানোর কাজসহ কতো স্বপ্ন ছিল ওর। কিন্তু আজ সবকিছু শেষ, আমার আর কিছুই থাকল না।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গ থেকে ময়নাতদন্ত শেষে নয়নের লাশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের বঙ্গবাজার সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়।সেখানে মরহুমের জানাজায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীসহ ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালকসহ বাহিনীটির উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, ফায়ার ফাইটার সোহানুর জামান নয়ন ছিলেন একজন দক্ষ কর্মী। দক্ষ কর্মীর সুবাদে তাকে সম্প্রতি সিলেট থেকে নিয়ে এসে রাজধানীর তেজগাঁও ফায়ার স্টেশনে সংযুক্ত করা হয়। কর্ম দক্ষতার কারণে দুই বছরে স্থান করে নিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস স্পেশাল টিমে।