নওগাঁয় সরকারিভাবে আমন চাল সংগ্রহ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা
প্রতি বছরই খাদ্য উদ্বৃত্ত নওগাঁ জেলায় আমন মৌসুমে সরকারিভাবে চাল সংগ্রহের ধুম পড়ে। ব্যস্ত সময় পার করে মিল মলিক, চাল ব্যবসায়ী ও সরকারি খাদ্য গুদামের চাল সংগ্রহকারীরা। তবে এবারের চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। চলতি মৌসুমে ধানের দাম বেশি হওয়ায় বেড়েছে চাল উৎপাদনের খরচ। ফলে লোকসান দিয়ে সরকারি গুদামে চাল বিক্রিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না খাদ্য অধিদপ্তরের চুক্তিবদ্ধ মিল মালিকরা। এতে করে সরকারিভাবে চাল সংগ্রহ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
তবে খাদ্য বিভাগের দাবি, উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় লোকসান গুনতে হলেও চুক্তিবদ্ধ মিলাররা গুদামে চাল পরিশোধ করবে। যদিও ব্যবসায়ীরা বলছেন, কেজিপ্রতি চার থেকে সাত টাকা পর্যন্ত লোকসান দিয়ে সরকারের কাছে চাল বিক্রি করা সম্ভব নয়।
নওগাঁ খাদ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নওগাঁ জেলায় চলতি আমন মৌসুমে সরকারিভাবে ২০ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন চাল কেনার বরাদ্দ ছিল। তবে সদর খাদ্য গুদাম, মহাদেবপুর খাদ্য গুদাম, মহিষবাথান খাদ্য গুদাম, স্বরস্বতীপুর খাদ্য গুদামসহ জেলার ২০টি খাদ্য গুদামে চুক্তি হয়েছে ১৭ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন চালের। এবার ২০ শতাংশ মিল মালিক ও চাল ব্যবসায়ী সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেননি। আর যারা চুক্তি করেছেন তারা লোকসানের মুখে পড়ে গুদামে চাল দিতে পারছেন না।
নওগাঁ জেলা অটোমেটিক রাইস মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. তৌফিকুর রহমান বাবু বলেন, বিগত কয়েক বছর ধরে আমরা দেখছি, সরকার যে দামে চাল কেনার প্রজ্ঞাপন দেয়, তার সঙ্গে বাজার দর মেলে না। এতে মিলারদের ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে। লোকসানের পরিমাণ বর্তমানে প্রতি কেজিতে চার থেকে পাঁচ টাকায় দাঁড়িয়েছে। এই পরিমাণ লোকসান করে সরকারের ঘরে চাল দেওয়া ব্যবসায়ীদের পক্ষে সম্ভব না।
তৌফিকুর রহমান আরও বলেন, ‘এমনিতেই নওগাঁয় ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ মিল মালিক ও চাল ব্যবসায়ী ব্যাংকের কাছে ঋণী। ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে কীভাবে সরকারকে সহযোগিতা করা যায়, সেটাই এখন ভাববার বিষয়। আমরা আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে সরকারকে বারবার বলার চেষ্টা করেছি চালের দাম বাড়ানোর জন্য। খাদ্য বিভাগ আমাদের আশ্বস্ত করার পর আমরা সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেছি। কিন্তু খাদ্য বিভাগ এখন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।’
নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘খাদ্য বিভাগের সঙ্গে চলতি আমন মৌসুমে নওগাঁর ৮০ শতাংশ মিল মালিক ও চাল ব্যবসায়ী চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। ২০ শতাংশ মিল মালিক ও চাল ব্যবসায়ী চুক্তিবদ্ধ হননি। যারা চুক্তিবদ্ধ হয়েছে তারা শুরুতে সরকারের ঘরে চাল সরবরাহ শুরু করে। কিন্তু ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদান খরচ দাঁড়িয়েছে প্রতি কেজি ৫৩ থেকে ৫৪ টাকা। আর সেখানে সরকার আমাদের দিচ্ছেন কেজি প্রতি ৪৭ টাকা। প্রতি কেজি চালে আমাদের সাত থেকে আট টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। এত বড় লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে সরকারকে চাল সরবরাহ করা মিল মালিক ও চাল ব্যবসায়ীদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।’
এদিকে নওগাঁ সদর খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মাসুদ রানা বলছেন, নওগাঁর বিভিন্ন হাটে বাজারে ধান-চালের দাম অত্যন্ত বেশি। ধান থেকে চাল উৎপাদনের খরচও বেশি। ফলে লোকসানের মুখে পড়ে মিল মালিক ও চাল ব্যবসায়ীরা সময়মতো সরকারি খাদ্য গুদামে চাল সরবরাহ করতে পারছেন না। যদি চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে আনা সম্ভব হয় তাহলে চুক্তিবদ্ধ মিলাররা দ্রুত চাল দিতে পারবে।
মহাদেবপুর সদর খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. জাহেদুর রহমান, মহিষবাথান খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উত্তম কুমার নন্দী ও স্বরস্বতিপুর খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পরেশ চন্দ্র মাহাতোও একই কথা জানিয়েছেন।
এদিকে, নওগাঁ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ফরহাদ খন্দকার দাবি করেছেন, ইতোমধ্যে চুক্তিবদ্ধ ৪৫ শতাংশ চাল সংগ্রহ সম্পন্ন হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা গতকাল শনিবার (৪ জানুয়ারি) পর্যন্ত সাত হাজারের বেশি চাল সংগ্রহ করতে পেরেছি। এখনও প্রায় দুই মাস সময় বাকি আছে। আশা করছি, আমরা শতভাগ চাল সংগ্রহ করতে পরব।’
ফরহাদ খন্দকার আরও বলেন, ‘মিল মালিকদের লোকসান হলেও চাল দেবে বলে আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। বিদেশ থেকেও চাল আমদানি অব্যাহত আছে। ওএমএস (খোলা বাজারে চাল বিক্রি) কার্যক্রম চলমান আছে। জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে বাজারে মনিটরিং কার্যক্রম এবং বাজারে অবৈধ মজুদবিরোধী অভিযান চলমান আছে। মূল কথা চাল ব্যবসায়ীদের সদিচ্ছা থাকলে চলতি আমন মৌসুমের সংগ্রহ অভিযান সফল হবে।’