‘ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন শেষ হওয়া উচিত’
দুপুর ১২টা ছুঁইছুঁই। এমন সময় রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে প্রবেশ করেন ৭৭ বছর বয়সী মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শুরুতে তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় আলাপ সেরে নেন। তারপর প্রবেশ করেন কার্যালয়ের নিজ দপ্তরে। সেখানে কুশলাদি বিনিময়ের পর অফ হোয়াইট সুয়েটারের ওপর ধূসর রঙের ব্লেজার পরিহিত বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল চা আনতে বললেন। এরপর শুরু হয় একান্ত আলাপচারিতা, যা চলতে থাকে পরবর্তী এক ঘণ্টা ২০ মিনিট ধরে।
৬০ বছরের অধিক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের আমলে শতাধিক মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়ে জেল খেটেছেন কয়েকবার। বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষকতা করা মির্জা ফখরুলের চাওয়া একটি গণতান্ত্রিক ও শান্তিময় বাংলাদেশ। আর সে জন্য দরকার অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। তাঁর দাবি, ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে যাওয়া উচিত। তিনি বলেছেন, দীর্ঘদিন আন্দোলন-সংগ্রামে থাকা বিএনপি অবশ্যই দাবি করতে পারে, ফ্যাসিস্টবিরোধী গণআন্দোলনের সমস্ত ভিত্তি তৈরি করেছে বিএনপি। গণতন্ত্রমনা সব রাজনৈতিক দল ও মানুষ জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিল, যে গণঅভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালাতে বাধ্য হন। আজ তার ভারতে পালানোর পাঁচ মাস পূর্তির দিন।
নতুন বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ সৃষ্টি করা বছরের শেষ দিন, অর্থাৎ ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গণঅভ্যুত্থান, রাজনীতিতে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী প্রত্যাশা, নতুন দল, বিএনপি-জামায়াত ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক অবস্থান, ব্যক্তিগত প্রত্যাশা, হতাশা ও অবসর জীবনসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্টাফ করেসপনডেন্ট মাসুদ রায়হান পলাশ।
এনটিভি অনলাইন : গণঅভ্যুত্থান হলো। শেখ হাসিনা পালাল। পরিবর্তিত এ পরিস্থিতিতে মহাসচিব হিসেবে বিএনপিকে নিয়ে আপনার শঙ্কা-আশা-প্রত্যাশার কথা জানতে চাই।
মির্জা ফখরুল : গণঅভ্যুত্থানের পরে আমরা আশাবাদী হয়ে উঠেছি। দেশে মৌলিক কিছু পরিবর্তন হবে। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং গণতান্ত্রিক ধারায় পরিবর্তনটা চাই। সেভাবে আমরা কাজ করছি। আপনারা জানেন যে, আমরা ১৫ বছর ধরে অহিংস আন্দোলন করেছি। প্রফেসর ইউনূসের কেবিনেটের কাছে আমাদের প্রত্যাশাটা সবচেয়ে বেশি। তিনি নিজে একজন প্রজ্ঞাবান ও বিচক্ষণ মানুষ। যারা কেবিনেটে রয়েছেন, তারাও বিজ্ঞ মানুষ। তারা দেশে একটা অবস্থা তৈরি করবে, যে অবস্থার মধ্যে একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে একটি পার্লামেন্ট তৈরি হবে। শঙ্কার জায়গাটা হলো, যদি এমনটা না হয় তাহলে গণঅভ্যুত্থানে মানুষের প্রত্যাশা, আত্মত্যাগ ও রক্তপাত সব বৃথা যাবে।
এনটিভি অনলাইন : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে বিএনপির দূরত্বের খবর গণমাধ্যমে এসেছে। আবার জামায়াতের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দৃশ্যমান। অন্যদিকে জামায়াত ও বিএনপির নেতারা একে অপরের বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য করছে। এ পরিস্থিতি কেন ঘটল?
মির্জা ফখরুল : ২০১২ সাল থেকে কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার সুনির্দিষ্ট দাবিতে আমরা আন্দোলন করেছি। এরপর ছিল গণতন্ত্র নিয়ে আন্দোলন। আন্দোলনের মধ্যে পর্যায়ক্রমে আমরা বিভিন্ন কৌশল নিয়েছি। শুরুতে ২০ দল ভেঙে দিয়েছিলাম। তখন জামায়াতের সঙ্গে আমাদের জোট ভেঙে যায়। কিন্তু আমাদের যোগাযোগটা অক্ষুণ্ন ছিল। পরবর্তীতে আমরা সবার মতামত ও অংশগ্রহণের ভিত্তিতে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করি। ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে সেই আন্দোলনে ডান-বাম সবাই ছিল। এরপরও দীর্ঘদিন হামলা-মামলাকে উপেক্ষা করে বিএনপি আন্দোলনের মাঠে ছিল। সেজন্য আমাদের অজস্র নেতাকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
সর্বশেষ ছাত্ররা বৈষম্যবিরোধী যে আন্দোলনটা করল, সেই আন্দোলন কিন্তু কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল না। এটা ছিল কোটার পক্ষের আন্দোলন। এটা পরে টার্ন ইনটু অ্যান্টি গর্ভমেন্ট। কারণ, আমরা সবাই মিলে ছাত্রদের পাশে ছিলাম। স্মরণ করেন, সে সময় সরকারের বিভিন্ন পক্ষ বারবার বলতো- আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াতের লোকজন থাকে রাস্তায়। আন্দোলনটা দানা বেঁধেছে শেষের কয়েকটা দিন। অর্থাৎ সরকারবিরোধী আন্দোলন কিন্তু কয়েকদিনের। ৩ আগস্ট তারা সরকার পতনের এক দফার ঘোষণা দেয়। ৩ থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে আন্দোলনটা চূড়ান্ত পর্যায়ে গেছে। এই যে চূড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়া, এটা তো কয়েকদিনে হয়নি। ধীরে ধীরে এ গণঅভ্যুত্থানের ভিত্তি তৈরি হচ্ছিল। দীর্ঘদিন ধরে মানুষ অন্যায়ভাবে নির্যাতিত হয়ে, জেলে গিয়ে ও গুম-খুন হয়ে এ গণঅন্দোলনের ভিত্তি তৈরি করছিল। এটা দীর্ঘ আন্দোলনের ফলাফল।
বিরোধ নেই কিন্তু আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের অভার রয়েছে
দীর্ঘ ১৫ বছর যে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, এর মধ্যে আমাদের ৬০ লাখ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, শুধু ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে। আমাদের ২০ হাজারের মতো নেতাকর্মীকে এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং করা হয়েছে। এমপিসহ ৭০০’র বেশি নেতাকর্মীকে গুম করা হয়েছে। আমাদের চেয়ারপারসনকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে জেলে দিয়েছে। অ্যাকটিং চেয়ারম্যান দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। আমাদের এমন একজন নেতা নেই, যাদের বিরুদ্ধে ২০-৫০টা মামলা নেই। কিন্তু এই জিনিসটাকে সবাই এখন উপেক্ষা করছে। এটাকে কেউ রিকগনাইজ করছে না। এই ব্যাপারটা আমাদের খুব কষ্ট দিচ্ছে। আমিসহ আমরা বহুবার জেলে গিয়েছি। আমরা ১৫ বছর ধরে যুদ্ধটা করছি। আপনি যেটা বলছেন, এই জায়গায় আমাদের কোনো বিরোধ নেই। কিন্তু, আমার মনে হয় আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের অভার রয়েছে। বোঝার অভাব রয়েছে। তাদের বুঝতে হবে, আমরা আন্দোলন করে এই পর্যায়ে এসেছি। আমরাও বুঝি খুব ভালো করে। আপনি দেখবেন, আমরা এই সরকারের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলছি না।
অনেকে বলছেন, মির্জা আব্বাস সাহেবের বক্তব্যের কথা। কিন্তু বুঝতে হবে, ওনার এমন বক্তব্য কেন এসেছে। উনি নিজে একজন ফ্রিডম ফাইটার। তিনি ৭১-কে ওউন করেন। তিনি সেটা বলতেই পারেন। ৭২-এর সংবিধান তো একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তৈরি হয়েছে। তারপরও সেটা কিন্তু এখন আর আগের মতো নেই। চেঞ্জ হয়ে গেছে। এখন সংবিধানে যেটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, এই সংবিধানের তিনটা অনুচ্ছেদ ও অন্য কতগুলো পরিবর্তন নিয়ে এসেছে যেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না। সেসব পরিবর্তন করার জন্য আমরা সুপারিশ দিয়েছি সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে। আমরা যেটা চাচ্ছি, সংবিধান সংস্কারে যে কমিশন গঠন করা হয়েছে, তারা সে রিপোর্টটা দিক আগে। সেটা সরকার প্লেস করুক আমাদের সামনে। তারপর আমরা সেটা নিয়ে কথা-বার্তা ও যুক্তি-তর্ক করব। হঠাৎ করে বললেন, কাল সংবিধান বাতিল করতে হবে। কেন?
ভাবখানা এরকম, বিএনপি এখন সবচেয়ে বড় শত্রু
বিএনপি একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল। আমাদের অনেকভাবে চিন্তা করতে হয়। যাদের সঙ্গে আমরা যুগপৎভাবে আন্দোলন করেছি, তাদের সঙ্গে আলোচনার বিষয় রয়েছে। ফলে, এগুলো একটু ঠান্ডা মাথায় আলোচনা করে ঠিক করতে হয়। এই সরকার যে দেশ চালাচ্ছে, আমরা তো এখনো বুঝতে পারছি না, তারা কী চাচ্ছে। সরকারের উপদেষ্টাদের একেকজন একেকরকম কথা বলছে। এভাবে তো হয় না। আমরা এত বড় কাজে হাত দিয়েছি, এই কাজটা কিন্তু একে অপরের সহযোগিতা ও আলোচনার মাধ্যমে করতে হবে। শত্রু বাড়ালে তো হবে না। ভাবখানা এরকম, বিএনপি এখন সবচেয়ে বড় শত্রু।
ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলনের সব ভিত্তি তৈরি করেছে বিএনপি
অথচ দীর্ঘদিন আন্দোলন-সংগ্রামে থাকা বিএনপি অবশ্যই দাবি করতে পারে— এই ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলনের সব ভিত্তি তৈরি করেছে বিএনপি। আমরা ছাত্রদের সবসময় স্বাগত জানিয়েছি। তাদের আত্মত্যাগ রয়েছে। এখানে আমাদের দলীয় লোকজনও মারা গেছে। সাধারণ মানুষ, সাধারণ শ্রমিক মারা গেছে। এটা তো একটা সর্বজনীন ব্যাপার ছিল। সেক্ষত্রে যদি দাবি করা হয়, তারাই (শিক্ষার্থীরা) সব করেছে, তাহলে তো হবে না। তারা জুলাই আন্দোলনের ঘোষণাপত্রে যে শব্দগুলো ব্যবহার করেছে, এগুলো তো আমরা গ্রহণ করব না। এই আন্দোলন তো সবাই মিলে করেছি। এই জিনিসগুলোকে মেনে নিতে হবে। সরকারের সুযোগ নিয়ে অনেক কিছু করা হচ্ছে। একটা রাজনৈতিক দল তৈরি করা হচ্ছে। ভালো কথা, এটাকে আমরা অবশ্যই স্বাগত জানাব। কিন্তু সরকারে থেকে কেন? তাহলে যারা কিংস পার্টি বলে, তারা তো ভুল বলে না। তরুণদের একটা দল আসবে, এটা তো অত্যন্ত ভালো। কিন্তু সেটা সরকারে থেকে বা সরকারের সমস্ত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কেন? সরকারে তাদের তিনজন উপদেষ্টা রয়েছে। এটাকে আমরা কী বলব?
এনটিভি অনলাইন : সরকারের পক্ষ থেকে একটি ঘোষণা কিন্তু দেওয়া হয়েছে— ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি ঘোষণাপত্র তৈরি করবে।
মির্জা ফখরুল : প্রধান উপদেষ্টা যেহেতু দায়িত্ব নিয়েছেন, সেহেতু তাকে সব দলগুলোকে চিঠি পাঠাতে হবে। আলোচনা করতে হবে। আলোচনা ছাড়া কোনো কিছুই সম্ভব না।
এনটিভি অনলাইন : আমরা শুনলাম, শিক্ষার্থীদের এ ঘোষণা নিয়ে আপনি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেছেন। আপনাদের মধ্যে কী কথা হয়েছে?
মির্জা ফখরুল : প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। কী কথা হয়েছে, সেটা বলা যাবে না। তবে আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। তারপরই কিন্তু সরকারের প্রেস সেক্রেটারি স্টেটমেন্ট দিয়েছে, ছাত্রদের ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই। সেটা তাদের ব্যক্তিগত।
এনটিভি অনলাইন : আপনাদের সংগ্রামে যারা রয়েছে, তাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত কথা বলেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বা নাগরিক কমিটির সঙ্গে আপনারা কেন ডায়ালগ (সংলাপ) করছেন না?
মির্জা ফখরুল : এখন পর্যন্ত তারা আমাদের সঙ্গে কোনো প্রস্তাব দেয়নি ডায়ালগ করার জন্য। তারা এসেছে আমাদের কাছে, কথা বলেছে কয়েকবার। কিন্তু তারা রাজনৈতিক দল গঠন করবে বা রাজনীতি করছে বা করবে— এ কথা আমাদের বলেনি। সে ব্যাপারে আমাদের সঙ্গে কোনো আগ্রহ প্রকাশ করেননি। আমরা তো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলছি। তাদের সঙ্গে আমাদের ফরমালি কোনো কথা না হলেও সবসময় আলোচনা হয়।
জামায়াতের সঙ্গে আমাদের নৈকট্য বা দূরত্ব ওইভাবে ইস্যু না
এনটিভি অনলাইন : জামায়াতের সঙ্গে যে দূরত্ব, এ ব্যাপারে যদি বলতেন।
মির্জা ফখরুল : জামায়াতের সঙ্গে আমাদের নৈকট্য বা দূরত্ব যা কিছু ছিল, এর আগে যখন অ্যালায়েন্স ছিল। ওটা তো আমরা আগেই ভেঙে দিয়েছি। ফলে জামায়াতের সঙ্গে আমাদের নৈকট্য বা দূরত্ব ওইভাবে ইস্যু না। তারা তাদের রাজনীতির মতো কথা বলছে। আমাদের ছেলেরা যদি কেউ কিছু বলে থাকে, তারা তাদের মতো বলছে।
এনটিভি অনলাইন : রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর অনেক জায়গায় বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দখল-চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে আপনাদের ভাবনা কী?
মির্জা ফখরুল : ব্যাপারটা হচ্ছে, যখন একটা পরিবর্তন হয়, বিশেষ করে এই ধরনের একটা গণঅভ্যুত্থান ঘটে, বাংলাদেশের ইতিহাস তো অনেক। আমাদের অনেক বয়স হয়েছে। এমন একটা পরিবর্তনের পরে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি, এই ইতিহাস আপনি পাবেন না। কিছু মানুষ দলের নাম ভাঙিয়ে এগুলো করেছে। কিন্তু যেখানেই এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে, আমরা খবর পাচ্ছি, ব্যবস্থা নিয়েছি। এই ধরনের ঘটনা এখন অনেক কমে এসেছে।
এনটিভি অনলাইন : মামলার আসামি কে হবে, এগুলোও নাকি বিএনপির কেউ কেউ ঠিক করে দিচ্ছে?
মির্জা ফখরুল : এগুলো ভুল কথা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে একটা ক্যাম্পেইন চলছে বিএনপির বিরুদ্ধে। যেহেতু বিএনপি একটা পটেনশিয়াল পলিটিক্যাল পার্টি, অ্যান্টি বিএনপির যারা লোক আছে, তারা এই ক্যাম্পেইনটা করছে। যারা মনে করছে, বিএনপি একটি শক্ত প্রতিপক্ষ, তাদের ঘায়েল করা দরকার, তারা এগুলো করছে।
সংস্কারের প্রস্তাব বিএনপির
এনটিভি অনলাইন : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ একটি পক্ষ সংস্কার শেষে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। অন্যদিকে যৌক্তিক সংস্কার শেষে বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। এ ক্ষেত্রে সমাধান কী হতে পারে। এ ছাড়া বিএনপি কবে নাগাদ নির্বাচন চায় বিএনপি?
মির্জা ফখরুল : সংস্কারের প্রস্তাব তো আমাদের। ২০১৬ সালে আমাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ভিশন-২০৩০ দেয়। এখন যেসব বিষয়ে সংস্কারের কথা আসছে, তার প্রত্যেকটা রয়েছে ওর মধ্যে। এখানে প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য, দুই কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট— এর সবই আছে। এরপর আবার ২০২২ সালে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমস্ত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে দীর্ঘ দুই বছর এটার ওপর কাজ করে আমরা ৩১ দফা দিয়েছি। যেটা সংস্কার। রাষ্ট্রের পরিবর্তনের রূপরেখা। এখন যারা বলছে, আমরা সংস্কার চাই না, তারা ওই ক্যাম্পেইনটা করছে বিএনপিকে একেবারে ম্লান করার জন্য। আমরা সংস্কার চাই। তবে সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে তো অসুবিধা নেই।
সংস্কার করতে এখন থেকে ৬ মাসের বেশি লাগা উচিত না
এখানে একটা বেসিক প্রশ্ন রয়েছে। সংস্কার যে করবেন, ইপ্লিমেন্ট করবেন কীভাবে? ধরেন, সংবিধানের একটি জায়গায় আমরা সবাই একমত হলাম, এটা পরিবর্তন করা দরকার। এটা ইপ্লিমেন্ট কে করবে? তার জন্য তো পার্লামেন্ট লাগবে আপনার। এর জন্য তো ইলেকশন লাগবে। সেটাই আমরা বলছি। ইলেকশন হলে সংসদ থেকে সংস্কারগুলো দ্রুত হবে। তার আগে নির্বাচনের জন্য যেটা দরকার, সেটা করেন। প্রশাসনের জন্য যেটা দরকার, সেটা করেন। জুডিশিয়ারি কিছুটা হয়েছে, আরও হোক। সবচেয়ে বড় জিনিস যেটা আমরা উপেক্ষা করছি, অর্থনৈতিক সংস্কার। এখানে যে হারে লুট হয়েছে, অর্থনীতিকে ভেঙে ফেলা হয়েছে। ওই জায়গাগুলোতে মৌলিক কাজ শুরু করা উচিত। সেটা এই গভর্নমেন্টই করতে পারে। কারণ, এখানে কিছু যোগ্য মানুষ রয়েছেন। তারা কাজ শুরু করেছেন। আমি মনে করি যে, ইট ক্যান বি ডান। এসব করতে খুব বেশি দিন না, এখন থেকে ৬ মাসের বেশি লাগা উচিত না।
২৫ এর ডিসেম্বরে ইলেকশন শেষ হয়ে যাওয়া উচিত
এনটিভি অনলাইন : ইলেকশন তাহলে কবে নাগাদ হলে ভালো হয়? আপনারা কী চান?
মির্জা ফখরুল : আমরা তো বলছি, ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন হলে ভালো হয়। ২৫ এর ডিসেম্বরের মধ্যে ইলেকশন শেষ হয়ে যাওয়া উচিত।
এনটিভি অনলাইন : ছাত্রদের ও নাগরিকদের যে একটি পারস্পরিক সহযোগিতামূলক কমিটি, তারা বলছে, সংসদ নির্বাচনের আগে একটা গণপরিষদ নির্বাচনে হাত দিতে পারি। তারা আবার বলছে, গণপরিষদটাই সরকারে রূপ নিতে পারে।
মির্জা ফখরুল : তারা তো তাদের কথা বলতেই পারে। কিন্তু এগুলোর নিয়ে ব্যাপক ডিবেটের ব্যাপার রয়েছে। আলোচনা করতে হবে। এগুলো করতে গেলে কতগুলো লেজিটিমেসির প্রশ্ন রয়েছে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পরে স্বাধীন বাংলাদেশে কিন্তু এটি গণপরিষদ হয়েছিল। তারা সংবিধান দিয়েছে। তারা ইলেকটেড লোক ছিল। সেখানে তাদের বৈধ্যতা ছিল। এখন কারা করবে এটা? গণপরিষদ নির্বাচনটাই বা কারা করবে? এই নির্বাচনটা আপনি কীভাবে করবেন? আপনি পার্লামেন্টে যান। গণপরিষদ বা গণভোটের ব্যাপার নিয়ে আসেন। পার্লামেন্ট ইলেকশনটা আপনারা এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন? পার্লামেন্ট ইলেকশন ছাড়া অনেক কিছুর মধ্যে যাওয়া ডিফিকাল্ট। ফান্ডামেন্টাল অ্যাসপেক্টের বা একটি মেজর থিংকের মধ্যে যখন আপনি যাবেন, তখন জনগণের মতামত ছাড়া আপনি কীভাবে দেবেন? রাতারাতি সব যদি পরিবর্তন করে ফেলতে চায়, তাহলে জনগণ সব গ্রহণ করবে? এই জায়গাটা আমার কাছে সমস্যা মনে হচ্ছে। এমনটা হয়, যদি সশস্ত্র বিপ্লব করতে পারে। কিন্তু আমরা তো ওই লাইনের না। যদি সেদিকে যাওয়ার চেষ্টা হয়, তাহলে তো আমরা সর্বশক্তি দিয়ে বিরোধিতা করব। কারণ, আমরা তো গণতান্ত্রিক একটি রাজনৈতিক দল।
এনটিভি অনলাইন : জাতীয় নাগরিক কমিটি বলেছে, শেখ হাসিনার বিচার না হলে তারা নির্বাচনে যাবে না। সেক্ষেত্রে আপনাদের বক্তব্য কী? আর আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনে আসে তাহলে আপনাদের দলীয় অবস্থা কী হবে?
মির্জা ফখরুল : আমরা আগেই বলেছি, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে যাবে কি যাবে না, সেটা আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত। আর আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হবে কি হবে না— এই সিদ্ধান্ত জনগণ নেবে। দল হিসেবে আমরা আমাদের কোনো মত দিচ্ছি না। শেখ হাসিনার বিচার না হলে তারা নির্বাচনে যাবে কি যাবে না, এটা তাদের ব্যাপার। আর শেখ হাসিনার বিচার তো হতেই হবে। সেটা কতদিন লাগবে কি লাগবে না, সেটা সরকার বলতে পারবে, বিচার বিভাগ বলতে পারবে। আমি মনে করি না, সে জন্য নির্বাচন আটকে থাকার সুযোগ রয়েছে।
এনটিভি অনলাইন : বিএনপি দীর্ঘদিন বলে আসছে, নির্বাচনে জয়ী হলে জাতীয় সরকার গঠন করবে। এখন এটা কোন প্রক্রিয়াতে গঠন করবে?
মির্জা ফখরুল : জাতীয় সরকার গঠন করব, এটা আমাদের ঘোষণা। আমরা জাতীয় সরকারটা কেন করতে চাই? আমরা রাষ্ট্রের মৌলিক পরিবর্তনের ৩১ দফা বাস্তবায়ন করতে চাই। এগুলো মেজর চেঞ্জেস। এগুলো হয়তো আমরা একা করতে পারব না। সে জন্য আমাদের সঙ্গে যারা যুগপৎ আন্দোলনে ছিল, তাদের নিয়ে কাজটা বাস্তবায়ন করতে চাই।
এনটিভি অনলাইন : এখানে জামায়াতের অংশগ্রহণ থাকবে কিনা?
মির্জা ফখরুল : জামায়াত ইসলাম তো আমাদের সঙ্গে ওই সময় আন্দোলনে ছিল না। তারা তাদের মতো আন্দোলন করেছে। তবে জামায়াতকে আমরা সঙ্গে নেব কি নেব না, সেই ব্যাপারে আমরা এখনও সিদ্ধান্ত নিইনি। ধরেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন করেছে এমন দল যদি সরকারে যেতে না চায়, তাহলে তারা বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবে। তবে আমরা সকলের মতামতের ভিত্তিতে এই মেজর চেঞ্জেস করতে চাই।
এনটিভি অনলাইন : আগস্টে সরকার পতনের পর ভারতবিরোধী অবস্থান আমরা দেখতে পাচ্ছি। ভারতের সঙ্গে বিএনপির কোনো বোঝাপড়া রয়েছে কিনা।
মির্জা ফখরুল : আমরা সব সময় মনে করি, বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম দেশ। অন্য কোনো দেশের সঙ্গে একটি সম্পর্ক তৈরি করে রাজনীতি করতে হবে, এটা আমরা মনে করি না। এটা আওয়ামী লীগ করেছে, ভারতের সঙ্গে তাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। আমরা মনে করি, বিদেশে আমাদের সবাই বন্ধু। কেউ আমাদের প্রভু না।
এনটিভি অনলাইন : খালেদা জিয়া আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন কিনা?
মির্জা ফখরুল : বেগম খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাবেন। এটা এখনো সম্ভব হয়নি এই জন্য যে, উনি এখনও অসুস্থ রয়েছেন। চিকিৎসকরা বলছেন, যখনই উনি যাওয়ার মতো উপযুক্ত হবেন, তখনই যাবেন।
এনটিভি অনলাইন : বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কবে নাগাদ দেশে ফিরতে পারেন বলে আপনি মনে করেন?
মির্জা ফখরুল : উনার কিছু কেস বাকি রয়েছে। এগুলো শেষ হয়ে গেলে তিনি দেশে আসবেন।
এনটিভি অনলাইন : দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন আপনার। আগেকার দিনের রাজনীতি থেকে বর্তমান সময়ের রাজনীতি, সবকিছুর সাক্ষী আপনি। বর্তমানে কেমন বোধ করেন?
মির্জা ফখরুল : এই মুহূর্তে খুবই অস্বস্তিকর। আমরা দীর্ঘ সময় লড়াই করেছি, সংগ্রাম করেছি। বারবার জেলে গেছি। পরিবারের দায়িত্ব ঠিকমতো গ্রহণ করতে পারেনি। আমার বাচ্চারাও আমার কাছে থেকে ঠিকমতো সময় পায়নি। আমার প্রত্যাশা ছিল, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পরে স্বস্তিমূলক একটি পরিবেশ তৈরি হবে। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো কোনো মহল পরিবেশ অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। প্রশাসনের মধ্যে কোনো পরিবর্তন হয়নি। একটা অর্গানাইজেশনে পরিবর্তন হয়নি। কোনো কোনো স্থানে দু-চারটা পরিবর্তন হয়েছে। এ ছাড়া সবখানে আওয়ামী লীগের লোকজন এখনও বসে আছে। মানে, ফ্যাসিস্টদের কাঠামোটা পুরোপুরিভাবে থেকে গেছে। তারাই সবকিছু কন্ট্রোল করছে। এক কথায় বলতে গেলে আমি পুরোপুরি অস্বস্তির মধ্যে রয়েছি।
এনটিভি অনলাইন : আগামীর বাংলাদেশ কেমন চান?
মির্জা ফখরুল : আমি আগামীর বাংলাদেশকে একটি সত্যিকার লিবারেল ডেমোক্রেটিক কান্ট্রি হিসেবে দেখতে চাই। যেখানে আপনি আপনার মত প্রকাশ করতে পারবেন। তার জন্য আপনাকে কোনো নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করতে হবে না। আপনি স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারবেন। আপনি লিখতে পারবেন। সব স্থানে সুবিচার প্রতিষ্ঠা হবে। অর্থনৈতিক উন্নতি হবে। মোটা দাগে সব অন্ধকার কাটিয়ে আমি শান্তিময় ও ভালোবাসাময় এক বাংলাদেশ দেখতে চাই।
এনটিভি অনলাইন : আপনি অবসর নিতে চান কবে?
মির্জা ফখরুল : আমি এখনই অবসর নিতে চাই। কিন্তু অবসর নেওয়ার জন্য এখন পরিস্থিতি অনুকূল নয়। আমি খুব ক্লান্ত হয়ে গেছি আসলে।
এনটিভি অনলাইন : অবসরে কী করতে চান?
মির্জা ফখরুল : অবসরে আমি গ্রামে চলে যেতে চাই। সেখানে আমার কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলোর দেখভাল করব। বই পড়ব, ছবি দেখব। পুরোনো বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সময় কাটাব।
এনটিভি অনলাইন : আপনাকে ধন্যবাদ।
মির্জা ফখরুল : আপনাকেও ধন্যবাদ।
[মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ১৯৬৩ সাল থেকে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত। সে হিসেবে তিনি তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে ৬২ বছর শেষ করেছেন। এর মধ্যে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষা ক্যাডারে ১৯৭২ সাল থেকে ১৮ বছর ঢাকা কলেজসহ বিভিন্ন সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। শিক্ষকতার মাঝে তিনি ডেপুটেশনে তিন বছরের অধিক সময় জিয়াউর রহমানের শাসনামলে তৎকালীন উপ-প্রধানমন্ত্রী এস এ বারীর ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে এরশাদ ক্ষমতায় এলে তিনি পুনরায় শিক্ষকতায় ফিরে যান। ১৯৮৬ সালে পৌরসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে মির্জা ফখরুল তার শিক্ষকতা পেশা থেকে অব্যাহতি নেন এবং সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯৮৮ সালে তিনি ঠাকুরগাঁও পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
জেনারেল এরশাদের সামরিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে যখন দেশব্যাপী আন্দোলন চলছে, তখন মির্জা ফখরুল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে যোগদান করেন। ১৯৯২ সালে মির্জা ফখরুল বিএনপির ঠাকুরগাঁও জেলা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। একইসাথে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী কৃষকদলের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।]