চিংড়ির চাহিদায় রদবদল, জনপ্রিয় হচ্ছে ভেনামি চিংড়ি
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব পড়েছে সাদা সোনা খ্যাত চিংড়ি রপ্তানি শিল্পে। বিশ্ববাজারে দেশের গলদা ও বাগদা চিংড়ির চাহিদা কমেছে প্রায় ৮০ শতাংশ। অন্যদিকে, চিংড়ির মূল্য ৪০ শতাংশেরও বেশি কমতে দেখা গেছে। এখন বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হচ্ছে ভেনামি জাতের চিংড়ি। তুলনামূলক কম দামের কারণে বিদেশের বাজার অনেকটাই দখল করেছে ভেনামি জাতের চিংড়ি। সেজন্য দেশের বাজারে অস্বাভাবিক হারে চিংড়ির দরপতন ঘটেছে।
গত বছরের তুলনায় এ বছর বাগেরহাটের হাট-বাজারে প্রতি কেজিতে গলদা ও বাগদা চিংড়ির দাম ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা কমেছে। সেজন্য হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারকরা বিশ্ববাজার ধরে রাখতে বাণিজ্যিকভাবে ভেনামি চিংড়ি চাষের কথা বলছেন।
বাগেরহাট সদর উপজেলার বারাকপুর পাইকারি মৎস্য আড়ত ঘুরে দেখা গেছে, কেজিতে ১২টি চিংড়ি ধরে এমন আকারের বাগদা কেজিপ্রতি এক হাজার ১০০ টাকা, ১৫টির ক্ষেত্রে ৯০০ টাকা ও ২০টির ক্ষেত্রে ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর গলদা চিংড়ির ক্ষেত্রে ৮টি ধরে এমন আকারের কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ৯০০ টাকায়। উৎপাদন খরচের তুলনায় কম মূল্যে বিক্রি করায় ক্ষাতির আশাঙ্কায় অনেক চাষি বিকল্প পেশা খুঁজছেন।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এস হুমায়ুন কবির বলেন, ‘ভেনামি জাতের চিংড়ি বিশ্ববাজার দখল করেছে। স্বল্প জায়গায় কম খরচে এই চিংড়ির চাষ সম্ভব। দাম কমের কারণে বিদেশের বাজারে এর চাহিদাও অনেক বেশি। গত বছরের তুলনায় এ বছর বিদেশের বাজারে গলদা ও বাগদার চাহিদা কমেছে শতকরা প্রায় ৮০ শতাংশ। আর দাম কমেছে শতকরা ৪০ শতাংশ। গত বছর যে আকারের এক পাউন্ড বাগদা চিংড়ি বিক্রি হয়েছে ১০ ডলারে, এখন তা কমে বিক্রি হচ্ছে ছয় ডলারে। বিদেশের বাজারে দেশের বাগদা ও গলদা চিংড়ির চাহিদা না থাকায় এই অঞ্চলের ৬১টি হিমায়িত রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ১৪টি প্রতিষ্ঠান চিংড়ি ক্রয় করছে।’
এস হুমায়ুন কবির বলেন, ‘বিদেশে চিংড়ির বাজার ধরে রাখতে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। দেশে বাণিজ্যিকভাবে ভেনামি চিংড়ি চাষ করতে হবে। ২০২১ সালে আট মাস ধরে চার হাজার কন্টেইনার হিমায়িত চিংড়ি বিদেশে রপ্তানি করা হয়। আর ২০২২ সালে ওই আট মাসে মাত্র এক হাজার কন্টেইনার হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি করা হয়েছে। বিদেশের বাজারে চিংড়ি রপ্তানি কমে শতকরা ২০ ভাগে এসে নেমেছে।’
বাগেরহাটের বারাকপুর এলাকার চিংড়ি চাষি আশ্বাদ আলী জানান, প্রায় ২৫ বছর ধরে তিনি ৪০ বিঘা জমিতে মাছের চাষ করে আসছে। এক বিঘা জমিতে চিংড়ি চাষ করতে সব মিলিয়ে প্রায় এক লাখ টাকা খরচ হয়। বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকায়। এখন আর তিনি চিংড়ি চাষ করতে চায় না।
বাগেরহাট জেলা চিংড়ি চাষি সমিতির সভাপতি ফকির মহিতুল ইসলাম সুমন জানান, নানা কারণে সম্ভাবনাময় চিংড়ি শিল্প বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। রপ্তানিকারকরা আগের মতো চিংড়ি কিনছে না।
বাগেরহাটের বারাকপুর মৎস্য আড়ৎ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সৈয়দ জাকির হোসেন জানান, গত বছর এই সময়ে প্রতিদিন তাদের আড়তে প্রায় দেড় কোটি টাকার গলদা ও বাগদা চিংড়ি বিক্রি হয়েছে। এবছর সেই পরিমাণ চিংড়ি মাত্র ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকা বিক্রি হচ্ছে।
বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এএসএম রাসেল বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে চিংড়ির উৎপদান ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। জেলায় ৫৫ হাজার চাষি চিংড়ি চাষের সাথে যুক্ত। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বাগেরহাট জেলায় মোট ৩৫ হাজার মেট্রিক টন চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে। ওই অর্থবছরে খুলনা বিভাগ থেকে ২৪ হাজার ১০৪ মেট্রিট টন চিংড়ি বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়। এসব চিংড়ি রপ্তানি করে চার হাজার কোটি টাকা আয় করেছে দেশ। এর আগে ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে বাগেরহাট জেলায় মোট ৩৫ হাজার ৬৭২ মেট্রিট টন চিংড়ি উৎপাদন হয়। এর মধ্যে ২৩ হাজার ৩৬৭ মেট্রিক টন চিংড়ি রপ্তানি করে দেশ তিন হাজার ৭০০ কোটি টাকা আয় করে।’