৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার বাজেট পেশ
২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ দেশ গড়তে সাত দশমিক ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য চার লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার বাজেট পেশ করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ স্লোগান সংবলিত এ বাজেট পেশ করেন।
বাজেটে মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে তিন লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে আয় ধরা হয়েছে দুই লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১১ দশমিক ৭ শতাংশ। এ ছাড়া এনবিআর বহির্ভূত সূত্র থেকে কর রাজস্ব ধরা হয়েছে নয় হাজার ৭২৭ কোটি টাকা, যা জিডিপির দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। কর বহির্ভূত খাত থেকে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৩৩ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১ দশমিক ৩ শতাংশ।
প্রস্তাবিত বাজেটে অনুন্নয়নসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে দুই লাখ ৯১ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১১ দশমিক ৫ শতাংশ। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ধরা হয়েছে এক লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে সার্বিক বাজেট ঘাটতি এক লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা দেখানো হয়েছে, যা জিডিপির ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। এ ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক সূত্র থেকে ৫৪ হাজার ৬৭ কোটি টাকা, যা জিডিপির ২ দশমিক ১ শতাংশ এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৭১ হাজার ২২৬ কোটি টাকা, যা জিডিপির ২ দশমিক ৮ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪২ হাজার ২৯ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১ দশমিক ৭ শতাংশ এবং সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য ব্যাংক বহির্ভূত উৎস থেকে ২৯ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা সংস্থানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৮ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
এর আগে দুপুরে সংসদ ভবনের মন্ত্রিসভা কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের সভায় প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন করা হয়। এর পরই রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ প্রস্তাবিত বাজেটে সম্মতি প্রদান করেন।
এ ছাড়া অর্থমন্ত্রী আজ ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য তিন লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকার সংশোধিত বাজেট পেশ করেন। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেট ছিল চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকা।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের পর এটি হচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের পঞ্চম বাজেট। এ ছাড়া গত বছরের মতো এবারও সংসদে বিরোধীদলের উপস্থিতিতে বাজেট পেশ করা হলো।
প্রস্তাবিত বাজেটের উন্নয়নের লক্ষ্য ও কৌশল হচ্ছে টেকসই উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে জনগণের জীবনমান উন্নয়ন।
অর্থমন্ত্রী দুপুর ১২টা ৫২ মিনিটে বাজেট বক্তৃতার শুরুতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, চার জাতীয় নেতা, মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদ, অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা, গণতন্ত্র ও মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনে আত্মদানকারী শহীদ, ১৯৭৫-এর কালোরাত্রিতে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার বঙ্গবন্ধুর নিষ্পাপ স্বজন এবং অন্য শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে সঙ্গে নিয়ে অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করেন।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সংসদে রাষ্ট্রপতির গ্যালারিতে বসে বাজেট বক্তৃতা শোনেন। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনসহ বিভিন্ন বিদেশি কূটনীতিক, উন্নয়ন সহযোগী ও দাতা সংস্থার প্রতিনিধি, বিশিষ্ট আমন্ত্রিত ব্যক্তি এবং ঊর্ধ্বতন বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তারাও সংসদ ভবনে উপস্থিত থেকে বাজেট বক্তৃতা শোনেন।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশশত্রু কতিপয় কুচক্রী জাতির পিতাকে হত্যা করে জাতিকে রুদ্ধ করার ঘৃণ্য পদক্ষেপ নেয়।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এ কুচক্রীদের দেশবিরোধী কার্যকলাপ জাতিকে ১৬ বছরের জন্য জিম্মি করে রাখে। কিন্তু অপ্রতিরোধ্য এ জাতি প্রায় বিনা রক্তে বিপ্লব সাধন করে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। এই গণতন্ত্রকে সুসংহত করার অগ্রযাত্রা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে শুরু হয়। তাঁর নেতৃত্বে ২০০৯ সাল থেকে জাতির অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। এর ফলে জাতিসংঘ থেকে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। অচিরেই বাংলাদেশ উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে।
মুহিত বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিকে উন্নয়নের সোপানে নিয়ে যেতে ২০২১ ও ২০৪১ সালের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে দিয়েছেন। ২০২১ সালের লক্ষমাত্রা অনুযায়ী দেশ মধ্যম আয়ের দেশের দ্বারপ্রান্তে আর ২০৪১ সালের লক্ষ্য অনুযায়ি সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়তে সরকার কাজ করে যাচ্ছে।’ তিনি বাজেট বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন ও অভূতপূর্ব উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি অর্জনের কথা তুলে ধরেন।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘দ্রুততম সময়ে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের রূপরেখা বাস্তবায়নে বর্তমান সরকারের ঈর্ষণীয় সক্ষমতা ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। এটি শুধু সরকারের দাবি নয়, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সত্য। ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে একদিন যে দেশকে অবজ্ঞা করা হয়েছে, সে দেশ বিশ্ববাসীর কাছে এখন এক ‘উন্নয়ন-বিস্ময়’, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রযাত্রা এখন বিশ্বের রোল মডেল। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পরিসংখ্যান মতে, নামিক জিডিপির ভিত্তিতে বর্তমানে বাংলাদেশ পৃথিবীর ৪৩তম বৃহৎ অর্থনীতি আর ক্রয় ক্ষমতা সমতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান ৩২তম। ২০১৭ সালে দ্রুততর প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী শীর্ষ দশটি দেশের তালিকায় বাংলাদেশও রয়েছে। ‘প্রাইস ওয়াটার হাউজ কুপারস’-এর প্রক্ষেপণমতে ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৮তম বৃহত্তম অর্থনীতি এবং ২০৫০ সালে বাংলাদেশের অবস্থান হবে ২৩তম।’
অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় গত ৯ বছরে বিভিন্ন খাতে সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন চিত্র বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন। বিশেষ করে গত ৯ বছরে বিভিন্ন সংকট মোকাবিলায় সাফল্য, বিদ্যুৎ-জ্বালানি, ডিজিটাল বাংলাদেশ, কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যোগাযোগ, শিল্প-বাণিজ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, প্রবাসী কল্যাণ, নারী ও শিশু, ভূমি ব্যবস্থাপনা, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, আমদানি-রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও জনশক্তি রপ্তানি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও বিনিময় হার, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, স্থানীয় সরকার পুনর্গঠন ও ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ, কর্মসংস্থানসহ সব ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্যের বর্ণনা করেন।
এদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক অবকাঠামোগত খাতে মোট বরাদ্দের ২৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ, যার মধ্যে মানব সম্পদ খাতে- শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাতে ২৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ, ভৌত অবকাঠামো খাতে ৩০ দশমিক ৯৯ শতাংশ- যার মধ্যে রয়েছে সার্বিক কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ১২ দশমিক ৬৮ শতাংশ, বৃহত্তর যোগাযোগ খাতে ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
এ ছাড়া সাধারণ সেবা খাতে ২৫ দশমিক ৩০ শতাংশ, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) এবং বিভিন্ন শিল্পে আর্থিক সহায়তা, ভর্তুকি, রাষ্ট্রায়ত্ত, বাণিজ্যিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের জন্য ব্যয় বাবদ ৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এ ছাড়া সুদ পরিশোধ বাবদ ১১ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ, নিট ঋণদান ও অন্যান্য ব্যয় খাতে অবশিষ্ট শূন্য দশমিক ৫৪ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা, যোগাযোগ অবকাঠামো, ভৌত অবকাঠামো, আবাস, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, কৃষি, মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।