আমি বদলে গেলে পুরো সমাজ বদলে যাবে : ঢাবির ট্রান্সজেন্ডার শিক্ষার্থী অঙ্কিতা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) প্রথম ট্রান্সজেন্ডার নারী অঙ্কিতা ইসলাম। এমবিএর এই শিক্ষার্থী এনটিভি অনলাইনকে বলেছেন—‘আমি আজ পড়াশোনা করছি, কাজ করছি, পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছি এবং রাষ্ট্রের কর প্রদান করছি। আমার মতো এভাবে যখন পুরো কমিউনিটিটা কাজ করবে, তখন সামগ্রিকভাবে দেশ ও জাতির কল্যাণ হবে। দেশের অগ্রযাত্রায় এই কমিউনিটি (ট্রান্সজেন্ডার) ভূমিকা রাখতে পারবে।’
অঙ্কিতা ইসলাম বলেন, ‘আমাদেরকে যোগ্যতা প্রকাশের জায়গাটা দেওয়া হোক, সহযোগিতা করা হোক, আমাদের প্রতি সকলে সহনশীল মনোভাব রাখুক, এটাই আমার চাওয়া। কারণ, আজ আমি বদলে গেলে পুরো সমাজ বদলে যাবে। আর সমাজটা তো আমরাই।’
অঙ্কিতা গত বছরের ডিসেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের এমবিএ (মাস্টার্স অব বিজনেস অ্যাডমিনেস্ট্রেশন) প্রোগ্রামের ম্যানেজমেন্ট বিভাগে ভর্তি হয়েছেন। বেশ প্রতিযোগিতামূলক এক ভর্তি পরীক্ষায় ১৮৪তম মেধাস্থান অধিকার করে এ সুযোগ পান তিনি।
এদিকে, অঙ্কিতার এ পথযাত্রায় সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘ দুই বছরের একাডেমিক এই প্রোগ্রাম শেষ করতে তাঁকে দিতে হবে না কোনো ফি। এ ছাড়া অঙ্কিতার ভর্তির পর গত ১২ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কমিটির এক সাধারণ সভায় ‘আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম’-এ ভর্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন কোটার সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ট্রান্সজেন্ডার’ কোটাও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
টাঙ্গাইল জেলার নান্দুরিয়া এলাকার অদম্য এই ট্রান্সজেন্ডার নারীর বেড়ে ওঠা দরিদ্র পরিবারেই। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জীবন ধারণের জন্য টিউশন করিয়েই চলতে হতো একসময়। এভাবে বহু কাঠখড় পুড়িয়েই টাঙ্গাইলের করটিয়ায় সরকারি সা’দত কলেজ থেকে গণিতে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন অঙ্কিতা। এরপর ট্রান্সজেন্ডার পরিচয়েই সম্মানের সঙ্গে ব্র্যাক ব্যাংকে করেছেন চাকরিও। এইচএসসির পর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন থাকলেও বিভিন্ন বাঁধা-প্রতিবন্ধকতায় তা আর হয়ে ওঠেনি তার। কিন্তু স্নাতক শেষ হওয়ার পর ঢাবিতে ভর্তি হওয়ার মাধ্যমে সে স্বপ্ন খানিকটা হলেও পূরণ হল বলে জানান অঙ্কিতা।
অঙ্কিতা এনটিভি অনলাইনকে তুলে ধরেন বাধা-প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে এ পর্যন্ত আসার গল্প। যেখানে ফুটে ওঠে তার অপ্রতিরোধ্য এগিয়ে চলার উপাখ্যান। গল্পের শুরুতে তিনি শোনান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কথা। অঙ্কিতা বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক আগে থেকেই আমার পড়ার ইচ্ছা ছিল। স্নাতক শেষ করে যখন আমি চাকরিরত ছিলাম তখন মনে হলো যে, এমবিএটা কমপ্লিট করব। এরপর দেখি ঢাকা ইউনিভার্সিটি ভর্তির সার্কুলার দিয়েছে। পরে আবেদন করি। যদিও একটু ভয়ও কাজ করছিল এই ভেবে যে, ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠী থেকে কাউকে পরীক্ষা দিতে দেবে কি না বা ভর্তি করবে কি না। এরকম ভয় এবং অনিশ্চয়তা নিয়েই ভর্তি পরীক্ষার জন্য আবেদন করি।’
অঙ্কিতা আরও বলেন, ‘পরে পরীক্ষা দিই। পরীক্ষার ফলাফল ভালো হওয়ার পর ভাইভাতে ডাকা হয়। ভাইবার আগে আমি একটু ভয়ে ছিলাম যে, আমাদের জনগোষ্ঠী থেকে কাউকে নেয় কিনা বা আমাকে দেখে ভাইবা বোর্ডের যারা থাকেন তারা কোন রিয়্যাক্ট করেন কিনা। কিন্তু দেখলাম যে, তারা অনেক ফ্রেন্ডলি আচরণ করেছে এবং পরে ভাইভাতেও টিকে যাই। এরপর মেধাতালিকা অনুযায়ী আমি ম্যানেজমেন্ট সাবজেক্টটা পাই ও ভর্তি হয়ে যাই।’
ভর্তির পরের অবস্থার বর্ণনা দিয়ে অঙ্কিতা বলেন, ‘ভর্তি হওয়ার পরও পূর্ববর্তী প্রতিষ্ঠানে ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য যে প্রতিকূল পরিবেশ ছিল, এখানেও সেরকম পরিবেশ থাকে কি না এবং কোর্স ফি দিতে পারি কি না এসব নিয়ে একটু চিন্তায় ছিলাম। এ বিষয়ে কথা বলতে আমি উপাচার্য স্যারের সঙ্গে দেখা করি। এরপর উপাচার্য স্যার আমাকে কোর্স ফি মওকুফ করে স্কলারশিপ এ পড়ার ব্যবস্থা করে দেন।’
অঙ্কিতা বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ হয়ে গেছে, কিন্তু এ পর্যন্ত ট্রান্সজেন্ডার আইডেন্টি নিয়ে কেউ কোনো ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু আমি পরীক্ষা দিতে পেরেছি এবং অবশেষে ভর্তি হয়েছি। এটা আমার জন্য এবং আমার যে কমিউনিটি আছে তাদের জন্য খুব ইতিবাচক দিক বলে আমি মনে করি। এটা আসলে ভাবার সময় এসে গেছে যে, যে যাই করুক না কেন, কারও যোগ্যতা থাকলে কোনো কাজে বাধাগ্রস্ত করা উচিত নয়। এভাবে প্রতিটি জায়গায় আমাদেরকে সুযোগ দেওয়ার কারণে আমরা সম্পদে পরিণত হতে পারি। দেশের বোঝা না হয়ে সামগ্রিকভাবে আমরাও দেশের সম্পদে পরিণত হতে পারি।’
অঙ্কিতাকে ঢাবিতে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দেওয়ায় কর্তৃপক্ষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদেরকে যে সুযোগটা করে দিয়েছে তার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। এটা দেখে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেরও বিষয়টা বিবেচনা করা উচিত বলে মনে করি।’
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে অঙ্কিতা বলেন, ‘আমি আরও উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে চাই। শিক্ষা নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই। আর শিক্ষা অর্জন করে আমার কমিউনিটি এবং যারা যারা অধিকার বঞ্চিত মানুষ আছে, তাদের জন্য কাজ করতে চাই।’