জাবি উপাচার্যের তথ্য-উপাত্ত যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিতে
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তথ্য-উপাত্ত আগামীকাল দেওয়া হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসিত)। গত ৩ নভেম্বর শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে মন্ত্রী তথ্য-উপাত্তসহ লিখিত অভিযোগ দিতে বলেন।
আজ বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় প্রতিবাদী কনসার্ট শেষে সংবাদ সম্মেলনে একথা জানান আন্দোলনের সমন্বয়ক অধ্যাপক রায়হান রাইন।
সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নের জবাবে রায়হান রাইন বলেন, ‘ইউজিসির একজন সদস্য আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। আমরা শুনতে পেরেছি তারা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করবে। সেই তদন্তের জন্য তথ্য-উপাত্ত চেয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়েও পাঠানো হবে।’
জাবি উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ দিতে না পারলে শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আজ ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে রাইন বলেন, ‘প্রমাণ তো তদন্তের মাধ্যমে বের হবে। আমরা অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত চেয়েছি। আমাদের দাবি যৌক্তিক ও নৈতিক। তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে সুষ্ঠু তদন্তের মধ্যমে তা প্রমাণ হবে।’
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন আন্দোলনের সংগঠক নগর ও পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষার্থী রাকিবুল রনি। বক্তব্যে বলা হয়, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে চাই এই মেগা প্রজেক্টের কাজ শুরু করার আগে ই-টেন্ডার পদ্ধতির বদলে ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে টেন্ডার আহ্বান করা হয়। ফলশ্রুতিতে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা টেন্ডারের শিডিউল ছিনতাই করে। জাতীয় দৈনিকসমূহের মাধ্যমে জানার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সেই ঘটনার তদন্ত সাপেক্ষে বিচার দাবি করলে আজও তার বিচার হয়নি। পরবর্তীতে বিগত ২৩ আগস্ট বাংলাদেশ প্রতিদিন, ঢাকা ট্রিবিউন, যুগান্তর, ডেইলি স্টারসহ দেশের সর্বাধিক পঠিত প্রায় সব দৈনিক পত্রিকায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের টাকার ভাগ বাটোয়ারার বিস্তারিত তথ্য নিয়ে চাঞ্চল্যকর সংবাদ প্রকাশিত হয়। একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি ও তার পরিবারসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দুর্নীতির সংবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অংশীজনসহ পুরো জাতি হতবাক হয়ে যায়। টাকা ভাগাভাগির ব্যাপারে দুজন সাংবাদিক উপাচার্যের কাছে তার মন্তব্য জানতে গেলে তাদেরও হেনস্তা করা হয়।
উল্লেখ্য যে, আন্দোলন শুরু হয়েছিল ত্রুটিপূর্ণ মাস্টারপ্ল্যান পর্যালোচনা করা ও পাঁচতলা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলকে ঘিরে তিনপাশে তিনটি ১০ তলা হল নির্মাণ না করে তা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার দাবিতে। সব সংবাদ মাধ্যমে দুর্নীতির খবর প্রকাশ পেলে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা দুর্নীতির ঘটনার তদন্তের দাবি তোলে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দুর্নীতির ঘটনা পুরোপুরি অস্বীকার করে। এরই মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেগা প্রজেক্টের দুর্নীতিতে সংশ্লিষ্টতাসহ বিভিন্ন অভিযোগে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে পদচ্যুত করা হয় বলে আমরা সবাই জানি। এই ব্যাপারে সংবাদ মাধ্যমে ভিসি অভিযোগ করেন, বহিষ্কৃত দুজন তার কাছে প্রকল্পের টাকা থেকে চার থেকে ছয় পার্সেন্ট চাঁদা দাবি করে। এরপরের দিনই গোলাম রাব্বানী তাদের এই দাবিকে ‘ফেয়ার শেয়ার’ বলে অভিহিত করেন। হল সরানো, মাস্টারপ্ল্যান পর্যালোচনা এবং দুর্নীতির যে অভিযোগ গণমাধ্যমে এসেছে তার তদন্তের দাবিতে ক্যাম্পাস যখন উত্তাল তখনই ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার তিন নেতা টাকার ভাগ পাওয়ার বিষয়টি টিভি ক্যামেরার সামনে স্বীকার করেন। ক্যাম্পাসের আনাচে কানাচে টাকার ভাগ কে কত পেয়েছে, তা নিয়ে গুঞ্জন চলতে থাকে। আন্দোলন জোরদার হলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ ব্যাপারে কোনো ভ্রুক্ষেপ করেনি। উল্টো জাতির সামনে সাক্ষ্য দেওয়া তিন ছাত্রলীগ নেতাকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য করা হয়। তারা অভিযোগ করেন পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে প্রশাসন তাদের ভয়ভীতি দেখিয়েছে। এমনকি দুই দফায় বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। তাছাড়া আন্দোলনের দুই সংগঠক ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর হাতে প্রহৃত হওয়ার বিচারও আজ পর্যন্ত হয়নি। পরবর্তীতে আন্দোলনের মুখে প্রশাসন আমাদের সঙ্গে আলোচনায় বসলে প্রশাসন আমাদের দুটি দাবি মেনে নেয়। যদিও উপাচার্য আন্দোলনের শুরু থেকেই বলে আসছিলেন হল স্থানান্তর কিংবা মাস্টারপ্ল্যান পর্যালোচনা করতে গেলে পুরো প্রকল্পই বাতিল হয়ে যাবে। তবে তদন্তের দাবিটি উপেক্ষা করে করণীয় ঠিক করতে তিন কার্যদিবস সময় চায় প্রশাসন। এরপর দ্বিতীয় মিটিংয়েও তদন্তের ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নিতে উপাচার্য রাজি হননি এবং দুর্নীতিতে জড়িত থাকার ব্যাপার অস্বীকার করেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তাকে যেসব পত্রিকা দুর্নীতির খবর প্রকাশ করেছে এবং ছাত্রলীগের যে নেতারা টাকা পাওয়ার স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করি। কিন্তু তিনি তাতেও অপারগতা প্রকাশ করেন। উপরন্তু পরবর্তীতে আন্দোলনকারীদের উন্নয়নবিরোধী বলে আখ্যা দেন। আমরা আগেও বলেছি আবারও সুস্পষ্ট করে বলছি, আমরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন চাই এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দুর্নীতির যে অভিযোগ এসেছে, তার সুষ্ঠু তদন্ত চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি তাতে সাড়া না দেওয়ায় যে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত সে বিষয়টি পুরো জাতির সামনে দিবালোকের মত পরিষ্কার হয়ে যায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তাঁকে সসম্মানে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়ে সময় বেঁধে দিই। নির্ধারিত সময়ে তিনি পদত্যাগ না করলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর তার অপসারণ দাবি করে।’
বক্তব্যে আরো বলা হয়,’এই পরিস্থিতিতে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান হিসেবে পুরো পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে মহামান্য আচার্যের কাছে উক্ত বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য খোলা চিঠিও পাঠিয়েছি আমরা। শুরু থেকেই আমরা একেবারেই ধ্বংসাত্মক কিংবা আক্রমাণত্মক না হয়ে আমাদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে আসলেও প্রশাসনিক নির্দেশে আন্দোলনের এক অন্যতম সংগঠকের ওপর হামলা চালায় এক সহকারী প্রক্টর। অথচ প্রশাসন উল্টো কল্পিত নাটক সাজিয়ে হত্যাচেষ্টা মামলা দিয়ে আন্দোলনকারীদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করার চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে কর্মসূচির অংশ হিসেবে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিলে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি জুয়েল রানার নেতৃত্বে ছাত্রলীগের একটি ‘বিশেষ’ অংশ আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ভিসিপন্থী শিক্ষকরা এই হামলায় উসকানি দেয়। আমাদের পিতৃতুল্য শিক্ষকদের কাছ থেকে এমন আচরণ আমরা আশা করিনি। এই হামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আটজন শিক্ষকসহ অন্তত ৩৫ জন শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক আহত হন। এই ন্যাক্কারজনক হামলাকে উপাচার্য ‘গণঅভ্যুত্থান’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাসকে এই ন্যাক্কারজনক সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে তুলনা করবার স্পর্ধা পুরোজাতি ভালোভাবে নেয়নি। এখানেই উপাচার্য ক্ষান্ত হোননি, উপরন্তু ছাত্রলীগের ওই অংশের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় তিনিই এই হামলার ইন্ধনদাতা। এর মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন স্বৈরাচারী কায়দায় হল ভ্যাকেন্টের ঘোষণা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়। এমনকি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের প্রবেশও নিষিদ্ধ করা হয়। কেড়ে নেওয়া হয় সভা-সমাবেশ করার গণতান্ত্রিক অধিকার। সুতরাং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমরা জানাতে চাই, আমাদের আন্দোলন যৌক্তিক এবং শান্তিপূর্ণ। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রশাসন ও উপাচার্যের দ্বারা ষড়যন্ত্র, সন্ত্রাস ও নির্যাতনের শিকার। আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, দুর্নীতির অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত হলে উপাচার্য এবং তাঁর পরিবারসহ সংশ্লিষ্ট সবার দুর্নীতিতে যুক্ত থাকার প্রমাণ মিলবে। এ ঘটনার তদন্ত হলে তা চলাকালীন এই উপাচার্য তার পদে আসীন থাকতে পারবেন না। কেননা আমরা মনে করি, এই উপাচার্য পদে আসীন থাকা অবস্থায় তদন্তস্থলে তা পক্ষপাতদুষ্ট হবে। তদন্ত চলার সময়েও উপাচার্যকে অপসারণের দাবিতে আন্দোলন চলবে। আমরা দৃঢ়ভাবে মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল এবং চলমান মেগা প্রজেক্টের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য এই উপাচার্যকে অপসারণের কোনো বিকল্প নেই।’
সংবাদ সম্মেলন শেষে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। আগামীকাল শুক্রবার বেলা ১১টায় ছবি আঁকা ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হবে।