যাঁর কাছে গানই ছিল জীবন-মরণ, গানই ছিল প্রাণ
জীবনের গল্প বাকি রেখে এন্ড্রু কিশোর নেই এক বছর। অনুরাগী, বন্ধু-স্বজনদের মনে তা আজও বিস্ময় হলেও সত্যিই তাঁর শারীরিক উপস্থিতি নেই। আজও অনেকেই তাঁর মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না। যেমন মেনে নিতে পারছেন না জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদির উপস্থাপক, পরিচালক, লেখক ও প্রযোজক হানিফ সংকেত।
২০২০ সালের আজকের দিনে, অর্থাৎ ৬ জুলাই সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় এই কণ্ঠশিল্পী ৬৫ বছর বয়সে রাজশাহী মহানগরীর মহিষবাথান এলাকায় বোনের বাসায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। গুণী এ শিল্পীর মৃত্যুতে বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনে গভীর শোক নেমে আসে, আজও সেই শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি সংগীতপ্রিয়রা। আজ তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী।
এই শোকের দিনে ফেসবুকে এক বার্তায় হানিফ সংকেত লিখেছেন, ‘দেখতে দেখতে একটি বছর হয়ে গেল কিশোর নেই। বিশ্বাস করতে মন চায় না, অথচ এটাই সত্যি। এন্ড্রু কিশোর বাংলা গানের ঐশ্বর্য। যার খ্যাতির চাইতে কণ্ঠের দ্যুতি ছিল বেশি। যার কাছে গানই ছিল জীবন-মরণ, গানই ছিল প্রাণ। এই গানের জন্যই কিশোর পেয়েছে প্লেব্যাক সম্রাটের উপাধি। গানের জন্যই মানুষ তাকে ভালোবাসত। অবশেষে মরণব্যাধি ক্যানসারের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে গত বছরের এই দিনে সবাইকে কাঁদিয়ে পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নেয় সবার প্রিয় এন্ড্রু কিশোর।’
স্মৃতিচারণ করে হানিফ সংকেত লেখেন, ‘কিশোর যেমন প্রাণ খুলে দরাজ গলায় গাইতে পারত, তেমনই মানুষের সঙ্গেও প্রাণ খুলে মিশতে পারত। সব সময় নিজের সুবিধার চাইতে অন্যের সুবিধার দিকেই দৃষ্টি ছিল তার বেশি। কিশোরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক প্রায় ৪০ বছরের। একসঙ্গে অনেক আড্ডা দিয়েছি, বহু বার বিদেশে গেছি, একসঙ্গে থেকেছি। কিশোর ছিল ইত্যাদির প্রায় নিয়মিত সংগীতশিল্পী। কিশোর নেই মনে হলেই ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। এন্ড্রু কিশোর ছিল একজন আদর্শ শিল্পী, একজন মানবিক মানুষ। যার তুলনা সে নিজেই।’
‘কিশোর তার গানের মাধ্যমেই বেঁচে থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। বন্ধু যেখানে থাকো, ভালো থেকো। শান্তিতে থেকো,’ যুক্ত করেন হানিফ সংকেত।
উন্নত চিকিৎসার জন্য ২০১৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন এন্ড্রু কিশোর। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ১৮ সেপ্টেম্বর তাঁর শরীরে ক্যানসার ধরা পড়ে। এরপর তাঁকে কেমোথেরাপি দেওয়া হচ্ছিল। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক লিম সুন থাইয়ের অধীনে তাঁর চিকিৎসা হয়।
ক্যানসারের চিকিৎসা শেষে দীর্ঘ নয় মাস পর ২০২০ সালের ১১ জুন সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফেরেন এন্ড্রু কিশোর। এর মাত্র কয়েক দিন পরেই ৬ জুলাই অসীমের পথে পাড়ি জমান এ শিল্পী। ১৫ জুলাই রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারসংলগ্ন খ্রিস্টানদের কবরস্থানে মা-বাবার পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
১৯৫৫ সালে এন্ড্রু কিশোরের জন্ম রাজশাহীতে। সেখানেই কেটেছে তাঁর শৈশব ও কৈশোর। এন্ড্রু কিশোর প্রাথমিকভাবে সংগীতের পাঠ শুরু করেন রাজশাহীর আবদুল আজিজ বাচ্চুর কাছে। একসময় গানের নেশায় রাজধানীতে ছুটে আসেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, আধুনিক গান, লোকগান ও দেশাত্মবোধক গানে রেডিওর তালিকাভুক্ত শিল্পী হন।
বাংলা গানের কিংবদন্তি এই সংগীতশিল্পী ‘প্লেব্যাক সম্রাট’ হিসেবেও পরিচিত। বাংলা চলচ্চিত্রের গানে তাঁকে বলা যেতে পারে এক মহাসমুদ্র। কয়েক দশক ধরে সেই সমুদ্রে সাঁতার কেটে চলেছেন শ্রোতারা। ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যখানে’, ‘পৃথিবীর যত সুখ আমি তোমারই ছোঁয়াতে খুঁজে পেয়েছি’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ‘বেদের মেয়ে জোছনা আমায় কথা দিয়েছে’, ‘তুমি আমার জীবন আমি তোমার জীবন’, ‘ভালো আছি ভালো থেকো’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’, ‘চোখ যে মনের কথা বলে’সহ অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গান রয়েছে তাঁর।
এন্ড্রু কিশোরের স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছে। প্রথম সন্তানের নাম সংজ্ঞা আর দ্বিতীয় জনের নাম সপ্তক।