‘মৃত্তিকা মায়া’ কথা
আর্ট সিনেমার সাথে বাণিজ্যিক সিনেমার পার্থক্য সহজেই চোখে পড়ে। এই পার্থক্য অনেকের কাছে সহনীয়, অনেকের কাছে চমকপ্রদ, অনেকের কাছে বিরক্তিকর। কিন্তু আর্ট সিনেমা বলতেই ‘ঝিমুনি ধরানো’ ছবি, এমন একটা গড়পরতা ধারণা রয়েছে অনেকের। আবার এমনও ধারণা করা হয় যে আর্ট সিনেমা কখনো একটি বাণিজ্যিক সিনেমার মতো উপভোগ্য হতে পারে না। কিন্তু মৃত্তিকা মায়া নিঃসন্দেহে আর্ট সিনেমা সংক্রান্ত এই প্রচলিত সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করতে সক্ষম হয়েছে। আর্ট সিনেমাও বাণিজ্যিক সিনেমার মতো উপভোগ্য হতে পারে বরং কোনো অংশে বেশি উপভোগ্য হতে পারে- এর প্রমাণ মৃত্তিকা মায়া। একটি কুমার পরিবার নিয়ে ছবির কাহিনী আবর্তিত। পরিচালক গাজী রাকায়েত চেয়েছেন নান্দনিক ছবি নির্মাণের সব রকমের ব্যাকরণ আর উপকরণের যথাযথ প্রয়োগ ছবিতে ঘটাতে।
মৃত্তিকা মায়ার কাহিনী গড়িয়েছে ক্ষীরমোহন পালের জীবন নিয়ে, যিনি ছবির অন্যতম চরিত্র। পেশায় কুমোর এবং বিপত্মীক। থাকেন নাতনি পদ্মকে নিয়ে। নিজের তিন সন্তানের একজন স্ত্রীসহ মারা যায় (পদ্মর মা-বাবা)। আর দুজন থাকে শহরে। একজন ব্যাংকের পিয়ন, অন্যজন ব্যবসা করে। ক্ষীরমোহন বাবুর কুমোর পেশাকে তারা গ্রহণ করে না। এমনকি তার পেশাকে ছোটলোকের কাজ বলে মনে করে।
ক্ষীরমোহন পালের নাতনি পদ্ম দেখতে শ্যাম বর্ণের। এ জন্য কোনো পাত্রপক্ষ দেখে তাকে পছন্দ করে না। এতে পদ্ম অখুশি নয়। কারণ পদ্ম তাদের বাড়িতে আশ্রিত বৈশাখকে ভালোবাসে। ক্ষীরমোহন বাবু ছোট বেলায় বৈশাখকে তার বটতলার বৈশাখী মেলায় কুঁড়িয়ে পায়। তিনি ওই মেলায় তাকে পায় বলে নাম দেয় বৈশাখ।
মৃত্তিকা মায়া বাণিজ্যিক ছবি নয় বটে, তবে তাতে রোমান্টিকতার ছোঁয়া কিন্তু দারুণভাবে রয়েছে। উপস্থাপনের ভঙ্গিমাটি তথাকথিত বাণিজ্যিক ছবির মতো ‘প্রথম যেদিন তোমাকে দেখি সেদিন থেকেই ভালোবেসে ফেলি’ ধরনের নয় বরং তা নান্দনিকভাবেই ফুটে উঠেছে এ ছবিতে। বৈশাখ ও পদ্মর কথোপকথনে কোনো সুস্পষ্ট প্রেম বা ভালোবাসার আহ্বান সরাসরি দেখা যায় না। তাদের নিজেদের নামের সাথে জড়িয়ে আছে প্রকৃতি, তাদের দুজনের কথাতেও নিয়ামক প্রকৃতি, পৃথিবী কিংবা জীবনের বিচিত্র কক্ষপথ। বৈশাখ ও পদ্মের কথোপকথনের কিছু নমুনা দেওয়া যেতে পারে-
বৈশাখ : ‘নদীর পাড়ের লাহান? দিন দিন তুই যেন কেমন হইয়া যাইতাছস।’
পদ্ম : ‘কত সুন্দর মূর্তি গড় তুমি। তার কতটুকুইবা বুঝি? এত দিনের চেনা তুমি, তারপরও কত অচেনা।’
বৈশাখ : ‘কালো মাইনষের একই রূপ। আন্ধারেও যা আলোতেও তা।’
ক্ষীরমোহন তার পূর্বপুরুষের পেশা ও সম্মানকে মনেপ্রাণে ধারণ করেন। নিজ সন্তানরা তাদের বাবার পেশাকে পরিত্যাগ ও অসম্মান করে- এ জন্য ক্ষীরমোহন কুমোরের শিল্প রক্ষায় বৈশাখকে তার উত্তরাধীকারী মনে করে এবং পরে কুমোরের শিল্প রক্ষায় তার ভিটেবাড়ি ও মেলা বসার স্থান বটতলা তাকে লিখে দেয়। তবে, একদিকে সে যেমন তার পূর্বপুরুষের পেশার সম্মান ধরে রাখার ব্যাপারে অটল, তেমনি জাতভেদ আর বর্ণপ্রথার গোঁড়ামিও আষ্টেপৃষ্ঠে আকড়ে ধরে থাকে। তাই সে নাতনির বিয়ে ঠিক করে বুড়ো বয়সের একজন ধনী লোকের সাথে। যদিও তার সামনে যোগ্য পাত্র ছিল বৈশাখ। তবুও জাতভেদ আর সামাজিকতার পশ্চাদপসারতাকে পুরোদমে লালন করে ক্ষীরমোহন। অন্যদিকে, ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে বৈশাখ ঘৃণায় পিতৃসম ক্ষীরমোহনের দান করা সম্পত্তি প্রত্যাখ্যান করে।
তবে বৈশাখ কিংবা ক্ষীরমোহন, অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায় দুজনকেই। ক্ষীরমোহন যেমন অনেক ভালোবাসলেও শেষ পর্যন্ত জাতভেদের অন্ধ ধারণায় বৈশাখকে বঞ্চিত করে, তেমনি বৈশাখও সেই বঞ্চনাকে মেনে নিয়ে এই প্রথাকে জিইয়ে রাখে। সে হিসেবে অবহেলিত পদ্ম জীবনের শুরু এবং শেষ, সবখানেই অসহায় থেকে যায়। এই প্রথাকে ভাঙার উপায় ছিল হয়তো বৈশাখের কিন্তু সেও দিনশেষে দেখায়- সেই মেনে নেওয়া আর চোখের পানি ফেলার পুরনো মানসিকতা। সামাজিক ব্যবধান, জাত, ধর্ম, বর্ণ, সাম্যবাদ- এসবের সাপেক্ষে ‘মৃত্তিকা মায়া’ আবহমান বাংলারই হাজার বছরের এক গল্প বলেছে সাবলীল ভঙ্গিতে।
‘মৃত্তিকা মায়া’র শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মাটি ও ভালোবাসার কথা দিয়ে সাজানো। কুমোরের পেশা, ভাস্কর্য, জন্মস্থানের প্রতি টান এবং ভালোবাসার গল্প নিয়ে গড়ে ওঠা এ ছবি একেবারেই আমাদের মাটির গল্প, আমাদের জনপদের গল্প, আমাদের জীবনের গল্প, আমাদের নিজেদের গল্প।
গাজী রাকায়েত পরিচালিত এই ছবির বিভিন্ন ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তিতাস জিয়া, শর্মিমালা, রাইসুল ইসলাম আসাদ, অপর্ণা, মামুনুর রশীদ প্রমুখ।