আমিরের যত চরিত্র
আজ ১৪ মার্চ, পঞ্চাশে পা রাখলেন বলিউডের মিস্টার পারফেকশনিস্ট আমির খান। বলিউডে তাঁর যাত্রা সবসময়ই ছিল বর্ণাঢ্য। যেকোনো চরিত্রে পরিচালকদের ভরসার নাম আমির খান। তাইতো চল্লিশের কোঠায় যখন বয়স তখনো রাজকুমার হিরানি ‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবিতে এক কলেজছাত্রের চরিত্রে বেছে নেন আমিরকেই।
নিজেকে বারবার প্রমাণ করেছেন আমির, যদিও তাঁর প্রমাণের আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল না। তবুও আমির বারবার নিজেকে ভেঙেছেন আবার গড়েছেন। প্রতিটি ছবিতে উপস্থিত হয়েছেন অন্য এক মানুষ, অন্য এক চরিত্র, অন্য এক আমির হিসেবে। আমিরের ক্যারিয়ারের দিকে ফিরে তাকাই চলুন, দেখে আসি তাঁর বিচিত্র সব চরিত্রের দিকে।
পুলিশগিরি
বলিউডে পুলিশ সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। প্রত্যেক অভিনেতাই একাধিকবার পুলিশের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। আমির খানও পুলিশ সেজেছেন। ১৯৯৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘সারফারোশ’ ছবিতে পুলিশ অফিসার অজয় সিং রাঠোরের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন আমির। আর ২০১২ সালে সর্বশেষ জয়া আখতারের ‘তালাশ’ ছবিতে ইন্সপেক্টর সুর্জন সিং শেখাওয়াতের ভূমিকায়।
প্রেমিক
যে সময়টায় আমিরের বলিউডে পথচলা শুরু সেই সময়টাই ছিল প্রেমের। আবেগী সব প্রেমের ছবির ছড়াছড়ি তখন। সেখানে আমিরের অবদানও কম নয়। শারীরিক উচ্চতায় কিছুটা ঘাটতি থাকলেও তা অভিনয় গুণে উতরে গেছেন আমির।
১৯৮৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’ ছবিতে জুহি চাওলার বিপরীতে কলেজ পেরোনো প্রেমিক তরুণের ভূমিকায় অভিনয় করে আমির সবার মন জয় করে নেন। ছবির প্রত্যেকটি গান জনপ্রিয় হয়। রাজ চরিত্রে অভিনয় করে ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন আমির। বাংলাদেশেও এই ছবির রিমেক বানানো হয়, যেখানে সালমান শাহ-মৌসুমী অভিনয় করে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যান।
১৯৯০ সালে মুক্তি পায় জুহি চাওলা এবং আমিরের ছবি ‘দিল’। ১৯৯২ সালে মুক্তি পায় ‘জো জিতা ওহি সিকান্দার’। আমিরের ঠোঁটে ‘পেহলা নেশা’ গানটি এখনো মানুষ গুনগুনিয়ে গায়।
১৯৯৬ সালে মুক্তি পায় ‘রাজা হিন্দুস্তানি’। আমিরের সাথে ছিলেন কারিশমা কাপুর। ১৯৯৫ সালে মুক্তি পায় মণীষা কৈরালার সাথে ‘একেলে হাম একেলে তুম’।
ভক্তদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন রোমান্টিক হিরো হিসেবে। ১৯৯৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘মান’ ছবিতে মণীষা কৈরালার সাথে আমিরের জুটি ছিল হিট। পরের বছর মুক্তি পায় ‘দিল হ্যায় কি মানতা নেহি’। পূজা ভাট ও আমির খানের অভিনয় প্রশংসিত হয়। ভালোবাসার প্রতীক হয়ে ওঠে এই জুটি। তুমুল জনপ্রিয় হয় ছবির গানগুলো।
২০০৬ সালে কাজল এবং আমিরের ছবি ‘ফানা’ মুক্তি পায়। সেখানে এক অন্ধ মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করেন কাজল, যার প্রেমে পড়েন আমির।
কমেডি
আমির এমন একজন অভিনেতা যখন যে চরিত্র তাঁকে দেওয়া হবে, তিনি সেই মেজাজের অভিনেতা হয়ে উঠবেন। ১৯৯৪ সালে মুক্তি পায় রাজকুমার সন্তোশি পরিচালিত কমেডি ছবি ‘আন্দাজ আপনা আপনা’। আমির খান ও সালমান খানের অনবদ্য জুটি। ছবির প্রতিটা মুহূর্ত দর্শকদের হাসিয়েছেন দুই তারকা। অমর মনোহরের চরিত্রে আমির ছিলেন যথার্থই একজন কমেডিয়ান।
বিক্রম ভাট পরিচালিত ১৯৯৮ সালের ছবি ‘গুলাম’। সেখানে রানী মুখার্জির সাথে আমিরের গান ‘ক্যায়া বলতি তু’ ছিল তরুণ-তরুণীদের মুখে মুখে। এই ছবিতে আমিরের অভিনয় দর্শকদের হাসিয়েছে প্রচুর। ‘মেলা’ ও ‘রঙিলা’ ছবিতেও আমির দিলখোলা প্রাণবন্ত যুবকের চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন।
অ্যাকশন
ক্রিস্টোফার নোলানের নন লিনিয়ার থ্রিলার ‘মেমেন্টো’ অবলম্বনে বলিউডে নির্মাণ করা হয় ‘গাজিনি’ ছবিটি। এতে অ্যাকশন ও রোমান্টিক হিরোর চরিত্রে অভিনয় করেন আমির খান। চুলের নতুন ছাট, নতুন লুক নিয়ে বড়পর্দা মাত করেন আমির।
ইয়াশ রাজ প্রোডাকশন্সের ‘ধুম’ সিরিজের ভিলেন মানেই স্টাইলিশ ও বুদ্ধিমান চোর। এই সিরিজের তৃতীয় কিস্তিতে ছিলেন আমির। তাও আবার জমজ দুই ভাইয়ের চরিত্রে। সামার এবং সাহির। একই সময়ে দুই ভাই মিলে যেমন জাদু দেখান তেমনি আবার পুলিশকে বোকা বানিয়ে ছাড়েন। একইসাথে দুই চরিত্র করতে গিয়ে মোটেই তাল হারাননি আমির, ভালোভাবেই যে উতরে গেছেন, ধুম থ্রি ছবির লাভের অঙ্কটা তাই প্রমাণ করে।
অফ ট্র্যাক
বলিউডে বাণিজ্য এবং শিল্প যে একসাথে চলতে পারে সেই ফর্মুলার সফল প্রয়োগ দেখিয়েছেন আমির। ক্যারিয়ার যখন তুঙ্গে তখনো খুব বেছে বেছে অভিনয় করেছেন তিনি। নতুন পরিচালকদের সাথে কাজ করেছেন অনায়াসে।
২০০১ সালে নিজের প্রথম ছবি ‘দিল চাহতা হ্যায়’ নির্মাণ করেন ফারহান আখতার। তার মতো নতুন ডিরেক্টরের সাথে তখন বলিউডের কোনো প্রতিষ্ঠিত নায়কই অভিনয় করার ঝুঁকি হয়তো নিতেন না। আমির নিলেন, গল্পের ওপর ভরসা করে। ছবি হলো এবং আজও মানুষ ‘দিল চাহতা হ্যায়’ ছবির আকাশ মালহোত্রাকে মনে রেখেছে।
ছোট চুল এবং ঠোটের নিচে ছোট দাড়ির ফ্যাশন নিয়ে এসেছিলেন আমির এই ছবিতে। তার মতো স্টাইল স্টেটমেন্ট তৈরি করতে পেরেছেন খুব কম নায়কই।
২০০৬ সালে রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরা নির্মাণ করেন তাঁর দ্বিতীয় ছবি ‘রং দে বাসন্তী’। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ ছিল সেই ছবি। এ রকম ছবিতে অভিনয় করার সাহস সে সময়ে একমাত্র আমিরই দেখাতে পেরেছিলেন, তাও আবার পরিচালকের দ্বিতীয় ছবিতে। আমির অভিনয় করলেন এবং নিজেকে নতুনভাবে গড়লেন এই ছবির জন্য। চুলের স্টাইল পাল্টে ফেললেন। সেই সময়ের কলেজ পেরোনো তরুণ দলজিৎ সিং এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী চন্দ্রশেখর আজাদের ভূমিকায় অভিনয় করলেন। দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতির বিরুদ্ধে সেটা ছিল এক প্রতীকী প্রতিবাদ।
সাল ২০০৯। পরিচালক রাজকুমার হিরানি। পরিচালকের তৃতীয় ছবি, যেখানে আমিরকে প্রস্তাব করা হলো কলেজছাত্রের চরিত্রে অভিনয় করতে। আমিরের বয়স তখন ৪৪ বছর। পরিচালক কি ভেবে আমিরকে এই চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দিলেন সেটা তিনি নিজেও বলতে পারেননি। আমির তো কথা শুনে হিরানিকে রীতিমতো পাগল বলে টিটকারি করলেন। হিরানি বলেন, ‘আমার মনে হয়েছিল, আমির ঠিকই কোনো না কোনোভাবে চরিত্রটা করতে পারবে।’
আসলেই আমির কলেজপড়ুয়া ছাত্র রানছোর দাস শ্যামলদাস চানছোরের ভূমিকায় সব ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া ছাত্রদের প্রতীক হয়ে উঠলেন। নিজের বয়সকে ছাপিয়ে গেলেন অভিনয়ের গুণে।
২০০১ সালে আমির অভিনয় করেন ‘লগান’ ছবিতে। আশুতোষ গোয়াড়িকর পরিচালিত ছবিটি সহ প্রযোজনাও করেন আমির। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে একেবারেই সাধারণ গ্রামীণ মানুষদের ক্রিকেট লড়াইয়ের গল্প নিয়ে নির্মিত ‘লগন’ ছবিতে আমির ছাড়া আর কোন ‘স্টার কাস্ট’ ছিলে না। অভিনয়ের পর্যাপ্ত সুযোগ আর দেশপ্রেমের গল্পের জন্য আমির জড়িয়ে যান ছবিটির সাথে। ভিন্ন স্বাদের ছবিটি দর্শকরা লুফে নেন আমিরের কারণে।
‘পিকে’ এখন পর্যন্ত আমিরের সর্বশেষ ছবি। ধর্মীয় কুসংস্কার আর গোড়ামিগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয়েছে এখানে। নাম ভূমিকায় এলিয়েনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন আমির খান। সব সময় পান খাওয়া ভোজপুরি ডায়লগ আওড়ানো আমিরকে যে দর্শকরা আপন করে নিয়েছেন তা ছবিটির কয়েক শো কোটি আয়ের রেকর্ড দেখেই বোঝা যায়।
২০০৫ সালে মুক্তি পেয়েছিল ভারতীয় সৈনিক মঙ্গল পান্ডের জীবনী অবলম্বনে ছবি ‘মঙ্গল পান্ডে : দ্য রাইজিং’। মঙ্গল পান্ডের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য নিজেকে আরো একবার আমূল বদলে ফেলেন আমির। লম্বা চুল, বড় গোঁফ দিয়ে পরিবর্তন আনেন লুকে। বক্স অফিসেও সাফল্য পায় ছবিটি।
তারে জামিন পার। শৈশবে নানা সমস্যায় জর্জরিত শিশু ইশান। পরিবারের কেউ তাকে বুঝতে পারে না। নিজের ভেতর গুটিয়ে যাওয়া এই শিশুটিকে আবার ফিরিয়ে আনে তার শিক্ষক রামশংকর নিকুম্ভ। ছবির ইশান এবং বাস্তবের দারশিল সাফারি দুজনেরই শিক্ষক আসলে আমির। ২০০৭ সালে পরিচালনায় আমিরের হাতেখড়ি ‘তারে জামিন পার’ ছবির মাধ্যমে। ছবিটি প্রযোজনাও করেছেন তিনি। আইটেম সং নেই, কোনো নায়িকাও নেই। আছেন শুধু আমির আর আট বছর বয়সী দারশিল। আর আছে খুব আবেগী একটা গল্প। এখানেই তো আমিরের বিশেষত্ব। গল্পটাকে সবসময় বিশ্বাস করেন তিনি। সেই বিশ্বাসেই এত দূর।