এরিক ক্ল্যাপটনের গান এবং প্রেম
‘গিটার দেবতা’ বলা হয় তাঁকে। শরীরের প্রতিটি শিরায় তাঁর সংগীত। চার দশক ধরে তৈরি করেছেন মানুষের অনুভূতিকে ছুঁয়ে যাওয়া গান এবং সংগীত। কয়েক প্রজন্ম তাঁর গান শুনে গিটার হাতে তুলে নিয়েছে। তাঁর মতো করে বাজাতে বা গাইতে গিয়ে অনেকেই নিজের মতো করে গান গাওয়া শিখেছেন।
১৯৪৫ সালে ইংল্যান্ডের রিপেলে ৩০ মার্চ জন্মেছিলেন ক্ল্যাপটন। গানের মানুষ ক্ল্যাপটন ব্যক্তিগত জীবনের অনেক টানাপড়েন পেরিয়ে শুধু গান নিয়ে মেতে থেকেছেন। কানাডিয়ান সৈনিক বাবা, সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও তাঁকে মানুষ করেছেন নানা-নানি।
১৯৬০-এর দশকে ক্ল্যাপটনের সংগীতযাত্রা শুরু ‘দ্য ইয়ার্ড বার্ডস’ ব্যান্ডে যোগদানের মাধ্যমে। তবে তাঁর উত্থান ১৯৭০ ও ৮০-এর দশকে। এই সময়টা ছিল ক্ল্যাপটনের জাদুতে ঘেরা। শ্রোতাদের মোহগ্রস্ত করে রেখেছিলেন তিনি। ‘ওয়ান্ডারফুল টুনাইট’, ‘কোকেন’, ‘আই শট দ্য শেরিফ’- সেই সময়ের গান, যা এখনো সমান জনপ্রিয়।
‘স্লোহ্যান্ড’ নামেও ডাকা হয় ক্ল্যাপটনকে। রক অ্যান্ড ব্লুজ ঘরানার গানে তৈরি করেছেন নিজস্ব ধারা। ১৯৯০-এর দশকে ‘টিয়ার্স ইন হ্যাভেন’ এবং ‘লায়লা’ গান দুটো নতুন করে আনপ্লাগড ভার্সন করেছিলেন তিনি। তাঁর ক্যারিয়ারের এসব গান ভক্তদের কাছে পেয়েছে ক্ল্যাসিকের উপাধি।
তবে ব্যক্তিগত জীবনে পোড় খাওয়া মানুষ ক্ল্যাপটন। বিভিন্ন সময়ের এসব বেদনা উঠে এসেছে তাঁর গলায় গানের মাধ্যমে। বাবার কোনো স্মৃতি নেই তাঁর। বড় হয়েছেন গানের সাথে। ‘ক্রিম’ ব্যান্ডের জিঞ্জার বেকার এবং জ্যাক ব্রুসের সাথে বনিবনা না হওয়ায় কষ্ট পেয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন একসময়।
১৯৭০-এর দশকে মডেল প্যাটি বয়েডের সাথে প্রেম তাঁকে টালমাটাল করে দিয়েছিল। কারণ বয়েড ছিলেন তাঁরই কাছের বন্ধু বিটলসের জর্জ হ্যারিসনের স্ত্রী। বন্ধুপত্নীর সাথে প্রেমের সেই পোড়া স্মৃতি ক্ল্যাপটন ধরে রেখেছেন ‘লায়লা’ ও ‘ওয়ান্ডারফুল টুনাইট’ গানের মাধ্যমে।
‘লায়লা’ গানটি তিনি লিখেছিলেন জিম গর্ডনের সাথে মিলে। পারস্যের কবি নিজামি গজনবির ‘দ্য স্টোরি অব লায়লা অ্যান্ড মাজনুন’ কবিতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা হয়েছিল গানটি।
বয়েডের প্রতি দুর্বলতা ক্ল্যাপটনকে মাদকাসক্ত করে তোলে। কোকেনে অতিরিক্ত আসক্ত হয়ে পড়েন তিনি। ফলে সেই সময়ে লাইভ শো বা স্টুডিও অ্যালবামগুলোর কাজে বেশ খাপছাড়া হয়ে পড়েছিলেন ক্ল্যাপটন। জেজে কেলের লেখা ‘কোকেন’ গানটিতে গলা ফাটিয়ে ক্ল্যাপটন গেয়েছেন, কোকেন কখনো মিথ্যা বলে না (শি ডোন্ট লাই, কোকেন)। একসময় কোকেনের মোহ থেকে বেরোতে পেরেছিলেন ক্ল্যাপটন, কিন্তু ডুবে গিয়েছিলেন মদে।
১৯৭৯ সালে বিয়ে করেছিলেন প্যাটি ও ক্ল্যাপটন। ১৯৮০-এর দশকের শুরু থেকে নিজেকে কিছুটা সামলে নিতে শুরু করেন ক্ল্যাপটন। পাগলামি ছেড়ে মন দেন গানে। কিন্তু ১৯৮৮ সালে বিচ্ছেদ ঘটে প্যাটির সাথে। তখন ক্ল্যাপটন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন ইতালিয়ান মডেল লরি ডেল সান্তোর সাথে।
১৯৮৯ সালে বের হয় ক্ল্যাপটনের সলো অ্যালবাম ‘জার্নিম্যান’। তাঁর অন্যতম সেরা কাজ ধরা হয় এই অ্যালবামকে। এরপরেই জীবনের আরেক ধাক্কা তাঁকে পাগল করে তোলে। ক্ল্যাপটন আর লরির ছেলে কনর মাত্র সাড়ে চার বছর বয়সে ১৯৯১ সালে নিউইয়র্কে তাঁদের ৫৩ তলার অ্যাপার্টমেন্টের বেডরুমের জানালা থেকে পড়ে মারা যায়। সেই ব্যথা নিয়ে ক্ল্যাপটন গান ‘টিয়ার্স ইন হ্যাভেন’।
কখনোই জীবনটাকে নিজের মতো করে পাননি ক্ল্যাপটন। যাঁদের ভালোবেসেছেন বা তাঁকে যারা ভালোবেসেছে, সবাই দূরে সরে গেছে ভালোবাসা নিয়ে। সব সময় গান নিয়েই বেঁচেছিলেন তিনি, দুঃখকে সঙ্গে করে মাতিয়েছেন মঞ্চ। ভালোবাসাকে সংক্রমিত করেছেন গানের মাধ্যমে।
আজ সত্তরে পা দিলেন কিংবদন্তি এই গায়ক। শুভ জন্মদিন ক্ল্যাপটন।