মুহিতের বর্ণাঢ্য জীবন : সরকারি কর্মকর্তা থেকে দেশের দীর্ঘস্থায়ী অর্থমন্ত্রী
সদ্যপ্রয়াত সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাংলাদেশের অর্থনীতির ইতিহাসে একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। এর একটি বড় কারণ—তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি দিন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ১৯৮২-৮৩ ও ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে দুবার, এরপর ২০০৯-১০ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে টানা ১০ বারসহ সর্বমোট ১২ বার বাজেট পেশ করেন।
এর মধ্যে ২০০৯ সাল থেকে টানা ১০ বছর আবুল মাল আবদুল মুহিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন এবং সবচেয়ে বেশি বাজেট তিনিই উপস্থাপন করেছেন।
জন্ম, পড়াশোনা ও পেশাজীবন
আবুল মাল আবদুল মুহিতের জন্ম ১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি বর্তমান সিলেট শহরের ধোপা দিঘির পাড়ে পৈতৃক বাড়িতে। মুহিত শিক্ষাজীবনে কৃতিত্বের সাক্ষর রেখেছিলেন।
আবুল মাল আবদুল মুহিত ১৯৪৯ সালে সিলেট গভর্নমেন্ট পাইলট স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৫১ সালে ঐতিহ্যবাহী সিলেট মুরারী চাঁদ (এমসি) কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। সে পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন।
এরপর মুহিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। সেখানে তিনি ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। পরের বছর একই বিষয়ে তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
ভাষা আন্দোলনেও অংশ নিয়েছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। ছাত্রজীবনে সলিমুল্লাহ হল ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন মুহিত।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। চাকরির সময় তিনি অক্সফোর্ড ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে আবুল মাল আবদুল মুহিত ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত ছিলেন। যুদ্ধ শুরু হলে মুহিত পাকিস্তান সরকারের পক্ষ ত্যাগ করেন এবং সেখানে বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
এরশাদ সরকারের মন্ত্রী ও তারপর...
১৯৭৭-৮১ পর্যন্ত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি ১৯৮১ সালে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন। ১৯৮২ সালে এইচ এম এরশাদ ক্ষমতা দখল করলে মুহিতকে অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী করার প্রস্তাব দেন। মুহিত শর্তসাপেক্ষে রাজি হন। শর্ত দেন—নির্দলীয় সরকার গঠন করে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। কিন্তু, এরশাদ কথা না রাখায় মুহিত দুই বছরের মাথায় মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন।
পেশাগত জীবনে আবুল মাল আবদুল মুহিত বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন।
১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে ড. কামাল হোসেন আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গণফোরাম গঠন করলে সেখানে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। তবে, সে সময় তাঁকে খুব একটা সক্রিয় দেখা যায়নি।
রাজনীতিতে মুহিতের সক্রিয় পদচারণা শুরু হয় ২০০১ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে। তিনি সিলেট-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ওই নির্বাচনে অংশ নেন। কিন্তু, নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের কাছে পরাজিত হন।
এরপর মুহিত ২০০৮ সালের নির্বাচনে আবারও আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সিলেট-১ আসন থেকে নির্বাচন করে এম সাইফুর রহমানের বিপক্ষে জয়লাভ করেন।
২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ইশতেহার প্রণয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন মুহিত।
নির্বাচনে জয়লাভের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে আবুল মাল আবদুল মুহিতকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর তিনি টানা ১০ বছর অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।
অর্থমন্ত্রী হিসেবে মুহিত
বাংলাদেশে ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বাজেট উপস্থাপন করেছেন আবুল মাল আবদুল মুহিত।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের বরাতে সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলা বলছে—আবুল মাল আবদুল মুহিত আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী থাকাকালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা মোটামুটি ভালো ছিল। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে সঙ্গে প্রবৃদ্ধির মাত্রাও মোটামুটি ভালো ছিল এবং তা ক্রমান্বয়ে বেড়েছে।
এবং আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থমন্ত্রী থাকার সময় কৃষি ও শিল্পে বড় ধরনের কোনো সংকট লক্ষ্য করা যায়নি বলেও উল্লেখ করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
লেখক ও গবেষক হিসেবে মুহিত
আমলা, মন্ত্রী ও রাজনীতিবিদের বাইরে আবুল মাল আবদুল মুহিতের আরেকটি বড় পরিচয় লেখক ও গবেষক হিসেবে। তাঁর লেখা বিভিন্ন বই অ্যাকাডেমিক মহলে বেশ সমাদৃত।
বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় আবুল মাল আবদুল মুহিতের বেশ কয়েকটি বই প্রকাশ হয়েছে।
আবুল মাল আবদুল মুহিতের পাঁচটি বই প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় প্রকাশনা সংস্থা ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)।
সংস্কৃতিমনা মুহিত
সাংস্কৃতিক জগৎ নিয়ে বিশেষ আগ্রহ ছিল আবুল মাল আবদুল মুহিতের। মন্ত্রী থাকাকালে অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজনে হাজির হতেন।