ঢাবিতে শিবির সন্দেহে শিক্ষার্থীকে রাতভর নির্যাতন, সকালে হলছাড়া
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিজয় একাত্তর হলে শিবির সন্দেহে শাহরিয়াদ মিয়া উরফে সাগর নামের এক শিক্ষার্থীকে রাতভর মারধর ও মানসিক নির্যাতন করে হল থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। গতকাল রোববার (২২ জানুয়ারি) দিবাগত রাত ১১টা থেকে আজ (সোমবার) সকাল পর্যন্ত কয়েক দফায় এ নির্যাতন করার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগ কর্মীদের বিরুদ্ধে।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী শাহরিয়াদ মিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী।
অন্যদিকে, অভিযুক্ত ছাত্রলীগকর্মীরা হলেন—উক্ত হল ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল উদ্দিন, সাংস্কৃতিক সম্পাদক মাজেদুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক শাহনেওয়াজ বাবু, শাকিরুল ইসলাম সাকিব, গণযোগাযোগ উপসম্পাদক শাকিবুল ইসলাম সুজন, সাহিত্য সম্পাদক ইউসুফ তুহিন, প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক বায়েজিদ বোস্তামী, মানবসম্পদ উন্নয়নবিষয়ক সম্পাদক পিয়ার হাসান সাকিব, ঢাবির উপদপ্তর সম্পাদক মো. আবুল হাছান সাঈদীসহ আরও কয়েকজন ছাত্রলীগকর্মী। তারা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের অনুসারী।
হল ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, রাত ১১টার দিকে শিবির সন্দেহে শাহরিয়াদকে পদ্মা-৪০০৮ নম্বর কক্ষে নিয়ে মারধর ও জেরা করতে থাকে হল ছাত্রলীগের কর্মীরা। এক পর্যায়ে তাঁর সঙ্গে কে বা কারা জড়িত তাদের নাম প্রকাশ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। এরপর ভোর রাতে তাঁকে প্রক্টরিয়াল টিমের সামনেই শহীদুল্লাহ হল এলাকায় মারধর করা হয় বলে এক নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়। এছাড়া অভিযুক্তরা সকালে তাঁকে হল থেকে বের হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয় এবং সকালেও মারধর করে।
রাতে সরেজমিনে গিয়ে শিক্ষার্থীর হাত ও কানে মারধরের চিহ্ন দেখা যায়। যদিও অভিযুক্তরা মারধরের বিষয়টি অস্বীকার করেন। এরপর সকাল আটটার দিকে হল প্রাধ্যক্ষ ড. অধ্যাপক আব্দুল বাছির হলে এসে উভয় পক্ষের সঙ্গে কথা বলেন এবং পরে শাহরিয়াদকে প্রক্টরিয়াল টিমের হাতে তুলে দেন।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী শাহরিয়াদ সাগর বলেন, ‘এক জুনিয়রের সঙ্গে আমার ফোনে একটু কথা হয়েছিল। এটার সূত্র ধরে তারা (অভিযুক্ত) আমাকে ৪০০৮ নম্বর কক্ষে নিয়ে যায়। সারারাত আমার ফোন চেক করে। আমার কান, হাতসহ দেহের বিভিন্ন জায়গায় কাঠ দিয়ে আঘাত করে ও চড়-থাপ্পড় দেয়। তারা এসময় বাবা-মা তুলে অশালীন ভাষায় গালিগালাজও করতে থাকে। একপর্যায়ে, সাংবাদিকরা এলে তখন নির্যাতন বন্ধ করে। কিন্তু, সাংবাদিকরা চলে যাওয়ার পর আবার নির্যাতন শুরু হয়। এ নির্যাতন চলে সকাল সাড়ে সাতটা পর্যন্ত। তারা আমাকে একটা মিনিটও ঘুমাতে দেয়নি। এমনকি ফজরের নামাজও পড়তে দেয়নি। আমাকে সবচেয়ে বেশি মেরেছে সুজন, তুহিন আর মাজেদ। শুধু আমাকে নয় মাহমুদ নামের এক জুনিয়রকেও বেদম প্রহার করে আমাদের সেশনের রাজু, শুভ ও প্রান্ত।’
শাহরিয়াদ আরও বলেন, ‘আমাকে তারা আর হলে থাকতে দিবে না। এখন আমি আমার এক আত্মীয়ের বাসায় আছি। আমার শরীর খুব খারাপ, সারা রাত তারা বিনা কারণে আমার ওপর জুলুম করেছে।’
ঘটনার ব্যাপারে জানতে চাইলে অভিযুক্তদের মধ্যকার মাজেদুর রহমান নামে একজন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৯ সালে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তারপরও হলে শিবিরের সঙ্গে কাজ করে এরকম দুইজনকে ধরা হয়েছিল রাতে। তাঁকে ধরার পরে সাংবাদিক সমিতির সদস্যরা আসেন। এরপর তাঁদের সামনে সে (শাহরিয়াদ সাগর) স্বীকারোক্তি দেয় যে, সে শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং শিবিরের হয়ে কাজ করে। এরপর আজ সকালে আমাদের হলের প্রাধ্যক্ষের মাধ্যমে তাঁকে প্রক্টরিয়াল টিমের কাছে হস্তান্তর করা হয়।’
ভুক্তভোগীকে নির্যাতন করা হয়েছে কি—না জানতে চাইলে মাজেদুর রহমান বলেন, ‘শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছেলেগুলোকে যখনই ক্যাম্পাসে ধরা হয়, তখন কেউই কিন্তু নরমালভাবে দেখে না। এটাই স্বাভাবিক। কারণ, এই সংগঠনের কাজকর্ম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লিগ্যাল না। সেই হিসেবে আমরা উপস্থিত হওয়ার আগে যারা ধরেছে, তারা তাকে দুই-একটা চড়-থাপ্পড় দিতে পারে।’
মাজেদ আরও বলেন, ‘শাহরিয়াদ মাহমুদ নামের আরেকজন জুনিয়রকে দিয়েও শিবিরের কাজ করাতো। এই ছেলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করত। তার ফোন থেকেই তথ্য-প্রমাণ পেয়ে আসলে ওকে (শাহরিয়াদ) ধরা হয়েছে। ও তাকে গাইড করে কাজ করাচ্ছে। এজন্যই ওকে ধরা হয়েছে। আর যাকে দিয়ে কাজ করায় বা যার মাধ্যমে ধরা হয়েছে সেই ছেলেটাকে কিছু বলা হয়নি।’
ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বলেন, ‘ওই ছেলেটা (শাহরিয়াদ) স্বীকারোক্তিও দিয়েছেন শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং হলে ওই সংগঠনের একটি টিমের হেড। আমরাতো আসলে চাই না যে, এগুলোতে আমরা ইনভলভ হই। এজন্য হলের মারফতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের কাছে তাঁকে তুলে দেওয়া হয়েছে। আর আমি যখন বিষয়টা জানতে পেরেছি, তখন থেকেই আমার নির্দেশনা ছিল যে, কোনোভাবেই ওর গায়ে হাত দেওয়া যাবে না। সুস্থভাবে প্রশাসনের হাতে তুলে দিতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আব্দুল বাছির বলেন, ‘ছাত্র শিবিরের সঙ্গে ওর সম্পৃক্ততার বিষয়টি শারীরিকভাবে পাওয়া যায়নি। যান্ত্রিকতার মাধ্যমে পাওয়া গেছে। এর ফলে গতরাতে তারা (হল ছাত্রলীগ কর্মীরা) যখন তাকে চিহ্নিত করে, তখন তারা (ছাত্রলীগকর্মীরা) ব্যবহারের দিক থেকে তার সঙ্গে খারাপ আচরণ করে। আর হয়তো একটু আঘাত করেছে।’
ড. আব্দুল বাছির আরও বলেন, ‘মারধরের বিষয়টি না হলে ভালো হতো। মারধরের বিষয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে না হওয়াই ভালো। আমরা যদি লিখিত অভিযোগ পাই, তাহলে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’