আ. লীগ হলে টাকা, নইলে প্রবেশ নিষেধ!
ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে মনোনয়নপত্র সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে আওয়ামী লীগের লোকজন ছাড়া অন্য কোনো দল বা ব্যক্তি সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলা পরিষদে প্রবেশ করতে পারছেন না। স্বয়ং উপজেলা চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমেদ স্বপন অবস্থান নিয়েছেন উপজেলা কার্যালয়ে।
অভিযোগ উঠেছে, চেয়ারম্যান ফিরোজের বাধার কারণে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ছাড়া অন্য কোনো দল বা স্বতন্ত্র প্রার্থী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা বা জমা দিতে পারছেন না। চেয়ারম্যান ফিরোজ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি।
তিনদিন ধরে চেয়ারম্যান ফিরোজের নেতৃত্বাধীন ৫০ থেকে ৬০ জনের দল উপজেলা পরিষদ ভবনে অবস্থান নিয়েছে। মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতে আসা প্রার্থীদের কাছ থেকে লাখ টাকার ওপরে চাঁদা চাওয়ার অভিযোগও উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক প্রার্থী জানিয়েছেন, চেয়ারম্যান ফিরোজ আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কাছেও চাঁদা দাবি করেছেন। চাঁদার বিনিময়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করিয়ে দেওয়ার নিশ্চয়তাও দিচ্ছেন ফিরোজ!
উপজেলার কয়লা ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক ইমরান হোসেন। কাউন্সিলরদের ভোটাভুটিতে মাত্র এক ভোটের ব্যবধানে হেরে যান তিনি। ইমরান দাবি করেন, তারপরও জনগণ তাঁকেই চায়।
আজ রোববার ইমরান মনোনয়নপত্র জমা দিতে যান। তিনি বলেন, ‘উপজেলা পরিষদে যাওয়ার পরপরই আমার ওপর হামলা করে কাগজপত্র কেড়ে নেন মনোনীত প্রার্থী মহিদুল ইসলাম এবং যুবলীগের তুহিন, মুন্না, মারুফ, জুলফিকার ও মনিসহ ৩০ থেকে ৪০ জন।’
ইমরান আরো বলেন, ‘উপজেলা চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমেদ স্বপনও আমাকে ধাওয়া করেন। একপর্যায়ে আমি রিটার্নিং কর্মকর্তার কক্ষে মনোনয়নপত্র জমা দিতে ঢুকে পড়ি। সেখানে আমাকে কমপক্ষে ৩০ মিনিট অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। পরে পুলিশ আমাকে উদ্ধার করে। এ সময় আমার ভাই মেহেদী হাসান আলমকে মারধর করা হয়।’ মনোনয়নপত্র সংগ্রহের দিনেও একইভাবে অপদস্থ করা হয় বলে ইমরান জানান।
এদিকে এ ঘটনার সময় কলারোয়ায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। চেয়ারম্যান ফিরোজের পক্ষের সমর্থকরা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম লাল্টুর কার্যালয় ভাঙচুর করেন। ছাত্রলীগ নেতা ইমরান জানান, তিনি তাঁর এলাকায় সমর্থকদের নিয়ে পাহারায় আছেন।
এর আগে গতকাল শনিবার চেয়ারম্যান ফিরোজের সমর্থকদের বিরুদ্ধে কয়লা ইউপির চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ওয়ার্কার্স পার্টির মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রউফকে লাঞ্ছিত করে তাঁর মনোনয়নপত্র ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম লাল্টু এ ঘটনার জন্য সরাসরি উপজেলা চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফিরোজ আহমেদ স্বপনকে দায়ী করেন।
চেয়ারম্যান ফিরোজ বলেন, ‘প্রার্থীর সঙ্গে কেবল প্রস্তাবক ও সমর্থক থাকতে পারবেন। অন্য কেউ না। এর বেশি কেউ গেলে তাঁকে বাধা দেওয়া হয়েছে মাত্র।’
কলারোয়ার বিভিন্ন ইউপির একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী অভিযোগ করে বলেন, ‘ওই সিন্ডিকেটের হাতে যিনি নগদ ১০ লাখ টাকা দেবেন কেবল তিনিই মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে সেসব ইউনিয়নে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয়ী হবেন বলেও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।’
এ ব্যাপারে কলারোয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উত্তম কুমার রায় জানান, এ ধরনের কোনো অভিযোগ সম্পর্কে তাঁর কিছুই জানা নেই। তিনি বলেন, ‘উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সম্পাদকের মধ্যে বিরোধের জেরে কিছু ঘটনা ঘটলেও পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।’
এদিকে কলারোয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি অধ্যাপক বজলুর রহমান জানান, এ উপজেলায় বিএনপির কোনো চেয়ারম্যান ও মেম্বার পদপ্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারছেন না। তিনি বলেন, দেয়াড়া ইউনিয়নের বিএনপিদলীয় প্রার্থী ইব্রাহীম হোসেনের স্ত্রীর কাছ থেকে মনোনয়নপত্র কেড়ে নিয়েছেন ফিরোজের সমর্থকরা। যুগিখালী ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান রবিউল ইসলামের স্ত্রীর কাছ থেকে এবং জালালাবাদ ইউনিয়নের প্রার্থী রবিউল ইসলামের প্রতিনিধি মহিলা সদস্যের কাছ থেকেও মনোনয়নপত্র কেড়ে নিয়েছে ফিরোজ চক্র।
বিএনপি নেতা জানান, ফিরোজ চক্রের তোপের মুখে কয়লা ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান উপজেলা বিএনপির সম্পাদক আবদুর রকিব মোল্লাও তাঁর মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি। তিনি জানান, শুক্রবার রাতেও পুলিশ তাঁর বাড়িতে গিয়ে হুমকি দিয়ে এসেছে।
অন্য উপজেলায়ও অসন্তোষ
গতকাল শনিবার আশাশুনির শ্রীউলায় সাবেক ও বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যানের মনোনয়ন নিয়ে সংঘর্ষের জেরে একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি নূর মোহাম্মদকে আজ রোববার গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
গ্রেপ্তারের সময় নূর মোহাম্মদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি ও আমার সমর্থকরা আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী শাকিল ও তাঁর বাহিনীর হাতে মার খেয়েছি। অথচ আমার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে উল্টো পুলিশ আমাকেই গ্রেপ্তার করেছে।’
নূর মোহাম্মদ দাবি করেন, ইউনিয়নের ৬৫ কাউন্সিলরের মধ্যে তিনি ৫৫ ভোট পেয়ে একক প্রার্থী ঘোষিত হন। তা সত্ত্বেও পেশি ও অর্থশক্তির বলে তিনি কেন্দ্রের মনোনয়ন পাননি। এর প্রতিবাদ করাতেই তিনি মারধরের শিকার হয়েছেন বলে জানান।
নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘টানা ৪৮ বছর আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে এখন আওয়ামী লীগ শাসনামলেই আমার বিরুদ্ধে ২৬টি মামলা দেওয়া হয়েছে। নতুন করে আরো একটি মামলা দেওয়া হলো।’
অপরদিকে কালীগঞ্জ উপজেলার ধলবাড়িয়ায় চেয়ারম্যান পদে সজল মুখার্জি ৪৯ ভোট পেয়েও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি।
এ উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুরে মনোনয়নের জন্য দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গোবিন্দ মণ্ডল ও ডি এম সিরাজুলকে বাদ দিয়ে অন্য ব্যক্তিকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়ার প্রতিবাদে গতকাল শনিবার উপজেলার ফুলতলায় মানববন্ধন করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁরা জানান, দলের উপজেলা সভাপতি শেখ ওয়াহেদুজ্জামান মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে এই দুই স্থানে একজন রাজাকারপুত্র শওকত হোসেন ও ঋণখেলাপি প্রশান্ত সরকারকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দিয়ে আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তিকে বিজয়ী করার পরিকল্পনা করেছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শেখ ওয়াহেদুজ্জামান সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, মনোনয়ন না পেয়ে তাঁরা আবোলতাবোল বলছেন।
এদিকে সদর উপজেলার বৈকারি ইউনিয়নে বিএনপি সমর্থিত সদস্য প্রার্থী সরোয়ার হোসেন অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগের নেতা-সমর্থকরা তাঁর মনোনয়নপত্র কেড়ে নিয়েছেন।