রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ে আবাহনীকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন মোহামেডান
দেশের ফুটবল যখন নানা বিতর্ক আর অস্বস্তিতে ছেয়ে গেছে ঠিক তখনই যেন শান্তির সুবাতাস বইয়ে দিল দেশের ফুটবলের সবচেয়ে বড়
দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ঢাকা মোহামেডান ও ঢাকা আবাহনী। ফেডারেশনের কাপের ফাইনালে দুদলের লড়াইয়ে ঘিরে প্রাণ ফিরেছে ফুটবলে। মাঠের লড়াইও জানান দিয়েছে সেই বার্তা। ঢাকা ডার্বির রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ে ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণ হয় টাইব্রেকারে। শেষের রোমাঞ্চে আবাহনীকে হারিয়ে ফেডারেশন কাপের চ্যাম্পিয়নের মুকুট পরেছে মোহামেডান।
আবাহনী বনাম মোহামেডানের এই ডার্বিতে কী ছিল না? ১২০ মিনিট, ৮ গোলের ম্যাচ, পিছিয়ে পড়েও মোহামেডানের বারবার ফিরে আসা। টাইব্রেকারে স্নায়ুর চাপ ধরে রেখে রূপকথার জন্ম দেওয়া। মাঠে খেলোয়াড়দের লড়াই, মাঠের বাইরে ভক্তদের হাতাহাতি সবকিছু যেন নিয়ে গেল ফুটবলের সোনালি অতীতে।
কুমিল্লার শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে দুপুর থেকেই সাজ সাজ রব। দর্শকদের কারও গায়ে আকাশী জামা, কেউ সেজেছেন সাদাকালোয়। উৎসবের উপলক্ষ ফেডারেশন কাপের ফাইনাল। ফাইনালে মুখোমুখি বাংলার ফুটবলের দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ঢাকা মোহামেডান ও ঢাকা আবাহনী। ফাইনালের নির্ধারিত সময় ৪-৪ গোলে ড্র থাকে। টাইব্রেকারে আবাহনীকে ৪-৩ গোলে হারিয়ে ১২ বছর পর ফেডারেশন কাপের শিরোপা জিতল ঢাকা মোহামেডান।
এদিন শুরু থেকেই ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নেয় আবাহনী। লিগ চ্যাম্পিয়ন বসুন্ধরা কিংসকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠা মোহামেডানকে কিছুটা কোণঠাসা করে রাখে আবাহনী। ১৬ মিনিটে এলোমেলো মোহামেডানের সুযোগ নেয় আবাহনী। সাদাকালোদের রক্ষণ ভেঙে এমেকা দুর্দান্ত এক থ্রু বাড়ান ফাহিমের উদ্দেশ্যে। ডিফেন্সচেরা গতিতে এগিয়ে এসে বাঁ’পায়ে চমৎকার গোল করে দলকে এগিয়ে নেন ফাহিম।
গোল দিয়ে আরও উজ্জীবিত হয় আবাহনী। ধরে রাখে গতিশীলতা। তৈরি করে বেশ কিছু সুযোগ। মোহামেডানও পেয়েছিল। কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়। বরং ৪২ মিনিটে মোহামেডানের রক্ষণের দুর্বলতায় দ্বিতীয় গোল পায় আবাহনী।
নিজেদের অর্ধ থেকে লম্বা এক শট করেন হৃদয়। বল পান আবাহনীর তারকা ফুটবলার দানিয়েল কলিনড্রেস। ওয়ান টু ওয়ানে সহজেই পরাস্ত করেন মোহামেডানের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়কে। এরপর দারুণ শটে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন কলিনড্রেস।
প্রথমার্ধের অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয় মিনিটে বুলেট গতির শট করেন কলিনড্রেস। সেটি দারুণ দক্ষতায় সেভ করেন মোহামেডান গোলরক্ষক সুজন হোসেন। দুই গোলের লিড নিয়ে বিরতিতে যায় আবাহনী।
বিরতি থেকে ফিরে মোহামেডান শক্ত করেন মধ্যমাঠ। কোচ আলফাজ তিনজন মিডফিল্ডার নামান মাঠে। মধ্যমাঠের দখল নিয়ে দ্বিতীয়ার্ধে ম্যাচ নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে নেয় সাদাকালোরা। ৫৭ মিনিটে কামরুলের বাড়ানো লম্বা থ্রুতে আলমগীর মাথা ছোঁয়ালেও তা মেলেনি ঠিকঠাক। অনবদ্য এক ভলিতে গোল করে ব্যবধান কমান মোহামেডার অধিনায়ক সোলায়মান দিয়াবাতে। এক গোলে জেগে ওঠে মোহামেডান। কথায় বলে, মধ্য মাঠের দখল নেওয়া মানে ম্যাচের অর্ধেকটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেওয়া। মোহামেডান ঠিক সেই কাজটিই করল।
৫৭ মিনিটের পর ৬০ মিনিটে মুগ্ধকর টিম ওয়ার্কের নিদর্শন দেখালো মোহামেডান। শহীদুল সোহেল বাঁচালেন দূর থেকে আসা মুজাফারভের ক্ষিপ্র শট, সেখান থেকে জাফর ইকবাল বল বাড়ালেন, জটলার মধ্যে হেডার এবং গোল। আবারও গোলদাতা সোলায়মান। মোহামেডানের ১০ নম্বর জার্সি ও অধিনায়ত্ব কেন তাকে দেওয়া হয়েছে, তার প্রমাণ দিলেন তিনি।
ম্যাড়ম্যাড়ে এক ম্যাচ চার মিনিটের ব্যবধানে চাঙা হয়ে উঠল। মোহামেডান জানান দিল, ঢাকা ডার্বি এত সহজ নয়। শেষের আগে এখানে শেষ বলে কিছু নেই। যদি হয় ফাইনালের মতো মঞ্চ, তাহলে তো কথাই নেই।
৬৬ মিনিটে আবাহনীও জানান দিল, আমরাও ছেড়ে কথা বলব না। ফাহিমের শট গোলরক্ষক ঠেকিয়ে দিলেও এমেকাকে আটকাতে পারেননি। ৩-২ গোলে এগিয়ে যায় আবাহনী।
আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ হবে আর গ্যালারিতে উত্তেজনা, মারামারি থাকবে না, তা হয় নাকি! ৭৭ মিনিটে গ্যালারির একাংশে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন দুই দলের ভক্তরা। আইন শৃঙ্খলাবাহিনী এসে মেটান ঝামেলা।
৮৩ মিনিটে মাঠের উত্তেজনা বাড়ান সোলায়মান। কর্ণার থেকে হেডারে গোল করে ফের সমতায় ফেরান মোহামেডানকে। ফাইনালে পূর্ণ করেন নিজের হ্যাটট্রিক।
নির্ধারিত ৯০ মিনিট ৩-৩ সমতায় শেষ হলে খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। ১০৭ মিনিটে স্পটকিক থেকে গোল করে মোহামেডানকে ৪-৩ গোলে এগিয়ে নেন সেই সোলায়মান দিয়াবাতে। সম্প্রতি বাংলাদেশের ফুটবলে ফাইনালে কারও হ্যাট্টিক পর্যন্ত নেই, সেখানে তিনি করলেন চার গোল।
ফাইনালের চার গোলসহ মোট আট গোল নিয়ে আসরে তিনিই সর্বোচ্চ গোলদাতা।
১১৭ মিনিটে দূরপাল্লার শটে আবাহনীকে ম্যাচে ফেরান রহমত। তার গোলে ম্যাচে ফেরে ৪-৪ গোলের সমতা। এই গোল ম্যাচটাকে নিয়ে যায় টাইব্রেকারে।
টাইব্রেকারে মোহামেডান প্রথম শটে গোল করেন। সোলায়মান দিয়াবাতে পঞ্চম গোলটিতেও সফল। সেখানে প্রথম শট মিস করেন আবাহনী অধিনায়ক রাফায়েল আগুস্তো। এরপর গোল হয়েছে সমানতালে। মোহামেডানের চতুর্থ শট বাঁচিয়ে ম্যাচে আবাহনীকে ম্যাচে ফেরান সোহেল।
আবাহনীর পঞ্চম ও শেষ শটটি নিতে আসেন বিশ্বকাপ খেলা কোস্টারিকান তারকা কলিনড্রেস। কিন্তু তিনি মিস করে বসেন। আগুস্তো ও কলিনড্রেসের শট ফিরিয়ে শেষবেলার নায়ক বনে যান বদলি গোলরক্ষক আহসান হাবিব বিপু। এরপর মোহামেডানের হয়ে শেষ শটে গোল করে দলকে এক যুগ পর ফেডারেশন কাপের শিরোপা এনে দেয় কামরুলের শট। একই সঙ্গে ২০০৯ সালের সুপার কাপের পর ১৪ বছর পর কোনো ফাইনালে আবাহনীকে হারাল মোহামেডান।