সিন্ডিকেট ভেঙে ৬৫০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি
যশোর শহরের ধর্মতলা এলাকার একজন বড় মাংস ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম মা-বাবার দোয়া মিট হাউজ। খুচরা মাংস ব্যবসায়ীদের কাছে তিনি পাইকারী দরে যেমন মাংস বিক্রি করেন, আবার খুচরাও বিক্রি করেন।
সেনানিবাসসহ বিভিন্ন স্থানে গরুর মাংস সরবরাহও করেন এই নজরুল ইসলাম। ছুটির দিনে আট থেকে ১৪টি, বাকি দিনগুলোতে তিনি থেকে চারটি করে গরু জবাই হয় তাঁর প্রতিষ্ঠানে।
গরুর স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য আছে নিজস্ব পশু ডাক্তার। কর্মচারী আছে ১১ জন। সম্প্রতি হঠাৎ করেই শহরে মাইকিং করে ৬৫০ টাকা কেজি দরে গরুর মাংস বিক্রি করা শুরু করেন তিনি। অথচ যশোরের সব স্থানেই ৭৫০ টাকা দরে মাংস বিক্রি হয়।
বিষয়টি নিয়ে শহরের মাংস ব্যবসায়ীরা তো বটেই সাধারণ মানুষের মধ্যেও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। নজরুলের দোকানে দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতাদের ভিড় বাড়তে থাকে।
নজরুল বলেন, কোরবানির ঈদের পর মাংসের চাহিদা কমে যায়। অনেকের ফ্রিজে কয়েক মাস ধরে কোরবানির মাংস থাকে। তা ছাড়া গত ঈদে অনেক গরু অবিক্রিত থেকে যায়। সেসব গরু এখন বাজারে উঠছে। মাংসের দাম ৭৫০ টাকা হওয়ায় এমনিতেই ক্রেতার সংখ্যা কমে গেছে। অনেকের ফ্রিজে রাখা গরুর মাংস এখনও শেষ হয়নি। ফলে বাজারে গরুর দাম কমে গেছে অনেক। এ অবস্থায় তিনি হিসাব করে দেখেন ৬৫০ টাকা কেজি গরুর মাংস বিক্রি করলেও সব খরচ বাদে প্রতিদিন তাঁর ছয় থেকে সাত হাজার টাকা লাভ থাকবে। আর দাম কমলে সাধারণ মানুষও মাংস কিনে খেতে পারবে। সেই চিন্তা থেকেই তিনি শহরে মাইকিং করে ৬৫০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রির ঘোষণা দেন।
কিন্তু নজরুলের এ মাইকিংয়ের পর শহরের অন্য ব্যবসায়ীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। গত ২৯ আগস্ট তাঁর দুই কর্মচারী যখন মাইকিং করছিলেন, শহরের চুয়াডাঙ্গা স্ট্যান্ডের কয়েকজন মাংস ব্যবসায়ী হামলা চালিয়ে মাইক ভাঙচুর করেন। পরে পুলিশ হামলার অভিযোগে দুই মাংস ব্যবসায়ীকে আটকও করে।
নজরুল বলেন, এখনও অন্য মাংস ব্যবসায়ীরা তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। গাই গরু বা রোগা গরুর মাংস বিক্রি করছি বলে প্রচার চালাচ্ছে। তবে শহরের আরও কিছু ব্যবসায়ী এখন ৬৫০ টাকায় মাংস বিক্রি করতে শুরু করেছেন। আবার কিছু ব্যবসায়ী এখনও ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকায় মাংস বিক্রি করে যাচ্ছেন।
৭৫০ টাকা কেজি দরে যারা এখনও মাংস বিক্রি করছেন, তাঁরা মাত্রাতিরিক্ত লাভ করছেন বলে কিছু ব্যবসায়ী মনে করছেন। তাঁরা বলেন, এখন বাজারে দুই মণ মাংসের এঁড়ে (ষাঁড়) গরু বিক্রি হচ্ছে ৬০ হাজার টাকা। এর মাথা, ভুড়ি, পা, চামড়া বিক্রি হচ্ছে সাত থেকে আট হাজার টাকা। তাতে প্রতি মণ মাংসের দাম পড়ছে ২৫ থেকে ২৬ হাজার টাকা। কর্মচারী খরচ ও অন্য সব খরচ বাদে দিনে নিট লাভ ১৩ হাজার টাকা। মাসে লাভ গড়ে চার লাখ টাকা। এখন ৬৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে হলে লাভের পরিমাণ কমে যাবে, যা বেশিরভাগ ব্যবসায়ী মেনে নিতে পারছে না।
নজরুল ইসলাম বলেন, তিনি খুচরা মাংস ব্যবসায়ীদের কাছে ৬৩০ টাকা কেজি দরে মাংস বিক্রি করেন। আর খুচরা ক্রেতাদের কাছে ৬৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন।
খুচরা মাংস ব্যবসায়ীরা নজরুল ইসলামের কাছ থেকে মাংস নিয়ে ৬৫০ টাকা কেজি বিক্রি করলে কেজিতে ২০ টাকা করে তাদের লাভ হবে। আগে তিনি খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে ৬৫০ টাকা কেজি বিক্রি করতেন, আর খুচরা ব্যবসায়ীরা তা ৭৫০ টাকা কেজি বিক্রি করে একশ টাকা লাভ করতেন। একজন খুচরা ব্যবসায়ী দিনে এক মণ মাংস বিক্রি করলে তার লাভ হতো চার হাজার টাকা। তবে এখন তাদের লাভ কমে যাবে।
নজরুল ইসলাম আরও বলেন, মাংস ব্যবসায়ীদের কোনো সমিতি নেই। তারপরও একটা সিন্ডিকেট তৈরি করে তারা ৭৫০ টাকা কেজি নির্ধারণ করে রেখেছিলেন।
যশোর শহরের চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডের মাংস ব্যবসায়ী ফরহাদ প্রতিদিন গড়ে পাঁচ থেকে সাতটা গরু জবাই করেন। তিনিও খুচরা ক্রেতার পাশাপাশি খুচরা মাংস ব্যবসায়ীদের কাছেও মাংস বিক্রি করেন। নজরুল ইসলামের মতোই তিনি রেট নির্ধারণ করেছেন। তবে তিনি বলেন, নতুন এই রেটে খুচরা বিক্রেতাদের লাভ অনেক কমে যাবে। যার প্রভাবে বাজারে গরুর দাম আরও কমে যাবে। এর প্রভাব পড়বে খামারীদের ওপর।
ফরহাদ আরও বলেন, এখন যে দামে মাংস বিক্রি হচ্ছে, তাতে লাভ করা খুব কঠিন। মাংস ব্যবসায়ীদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে দাম কমানোর এ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, যা ব্যবসায়ীদের ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
একই বাজারে কবির হোসেন ও রেজাউল ইসলাম ৬৩০ টাকা কেজি মাংস কিনে ৭০০ টাকায় বিক্রি করছেন। তাঁরা বলছেন, মাংসের মধ্যে হাড়, চর্বির পরিমাণ, গাভি, রোগা গরুর মাংসের ভেজাল এসব করতে পারলে দাম কমানো যায়। কিন্তু তারা নিজস্ব পরিচিত ক্রেতাদের কাছে মাংস বিক্রি করেন, খারাপ কিছু দিতে পারেন না। ফলে দাম বেশি পড়ে যায়।
শহরের পুলেরহাটের মাংস ব্যবসায়ী এনামুল হক খোকনও ৬৩০ টাকা কেজি দরে গরুর মাংস বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, লাভ আগের চেয়ে এখন অর্ধেক হচ্ছে। এর চেয়ে দাম কমাতে গেলে গাই গরু বা রোগা গরুর মাংস দিতে হবে।
শহরের বড় বাজার কাঠেরপুল এলাকার বেশ কয়েকটি দোকানেও ৬৫০ টাকা কেজি দরে গরুর মাংস বিক্রি শুরু হয়েছে।
শহরের চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড এলাকার গৃহবধূ তানিয়া জাহাঙ্গীর চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড বাজার থেকে ৭০০ টাকা কেজি দরে এক কেজি গরুর মাংস কেনেন। তিনি বলেন, ‘কদিন আগেও ৭৫০ টাকা কেজি মাংস কিনেছি, আজ ৫০ টাকা কম।’
মাইকিং শুনে সদর উপজেলার এড়েন্দা থেকে ধর্মতলা মোড়ে মাংস কিনতে এসেছিলেন নাইমুর রহমান। তিনি নজরুল ইসলামের মা-বাবার দোয়া মিট হাউজ থেকে দেড় কেজি মাংস কেনেন।
নাইমুর রহমান বলেন, ‘আমাদের গ্রামে এখনও ৭৫০ টাকা কেজি দরে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে। এখানে ৬৫০ টাকা শুনে চলে এসেছি।’
যশোর সদর উপজেলার চুড়ামনকাটি ইউনিয়নের কমলাপুর গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ মোস্তফা। দীর্ঘদিন ধরে গরুর খামার পরিচালনা করে আসছেন। বর্তমানে তাঁর খামারে ৫২টি ষাঢ় আছে। মোস্তফা বলেন, গত কোরবানির ঈদে তিনি ৩৪টি গরু বিক্রির জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। কিন্তু মাত্র ১২টি গরু বিক্রি হয়। এ ১২টি গরু বিক্রি করে তার সাড়ে তিন লাখ টাকা লস হয়। কারণ গো-খাদ্যের মূল্য মাত্রাতিরিক্ত। গরু লালন-পালন করতে খরচ অনেক বেড়ে গেছে। বর্তমানে আস্ত গরু ওজন করে বিক্রি হয়, ২৫ হাজার টাকা মণ। এ দামে গরু বিক্রি করলে আসল তো দূরের কথা, লস হবে। এ কারণে এখন তিনি গরু বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মোস্তফা বলেন, ৩০ হাজার টাকা মণ হলে খামারিরা কিছুটা লাভ পেতে পারে।
যশোর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. রাশেদুল হক বলেন, সাড়ে ছয়শ টাকা কেজি গরুর মাংস কিছু কিছু জায়গায় বিক্রি হচ্ছে এবং এতে ভোক্তা লাভবান হচ্ছে। তবে ভোক্তার পাশাপাশি খামারিরাও যাতে লাভ করতে পারে, সেদিকেও আমাদের খেয়াল রাখতে হয়। তিনি বলেন, এক কেজি গরুর মাংস সাড়ে ছয়শ টাকায় বিক্রি হলেও খামারি লাভ করতে পারেন, যদি সায়েন্টিফিক উপায়ে তিনি গরু লালন-পালন করেন। বেশিরভাগ খামারির মধ্যে ভুল ধারণা, ১০০ ভাগ দানাদার খাবার খাওয়ালেই হয়তো গরু বেশি মোটাতাজা হবে। এতে খরচ অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু যদি দানাদার খাবারের পাশাপাশি কাঁচা ঘাস খাওয়ানো হয়, তাতে আরও ভালো ফল পাওয়া যায়। এতে উৎপাদন খরচও অনেক কমে আসে। গরু কেনা-বেচায় মধ্যসত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমাতে পারলে তাতেও খামারিদের কিছুটা লাভ বাড়বে।
রাশেদুল হক আরও বলেন, বৈশ্বিকভাবেই গো-খাদ্যের দাম এখন অনেক বেশি। এ কারণে আমরা সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছি পতিত জমি বা সরকারি জমি, রাস্তার পাশের জায়গায় কাঁচা ঘাস উৎপাদনের জন্য। এতে গরু লালন-পালনের খরচ অনেক কমে আসবে।