ফানুসের আলোয় আলোকিত পাহাড়ের আকাশ
ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে উৎসবে বান্দরবানে রং লেগেছে পাহাড়ে। মারমা সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ওয়াগ্যোয়াই পোয়েতে নতুন সাজে সেজেছে পাহাড়ি পল্লীগুলো। আজ রোববার (২৯ অক্টোবর) সকালে এ উৎসবের সূচনা হয়।
ওয়াগ্যোয়াই পোয়ের প্রথম দিনে কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ বিহার, রাজগুরু বৌদ্ধ বিহার, স্বর্ণমন্দির বিহার, রামজাদী বিহারে বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু ভান্তে ও বিহারের পুন্যার্থীদের মধ্যে ছোয়াইং (মিষ্টান্ন খাবার) বিতরণ করে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী শিশুকিশোর, তরুণ-তরুণী, নারী-পুরুষ। পরে সমবেত প্রার্থনায় অংশ নেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নরনারীরা।
সন্ধ্যায় ফানুস বাতি উড়ানোর মধ্য দিয়ে তিন দিনব্যাপী মূল অনুষ্ঠানমালার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। উদ্বোধনের পর বিহার এবং পাহাড়ি পল্লীগুলো থেকে গৌতম বুদ্ধের স্মরণে আকাশে উড়ানো হয় রং-বেরঙের শতশত ছোটবড় ফানুস বাতি।
এবারও জেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পিঠা তৈরি, ফানুস বাতি উড়ানো, মঙ্গল প্রদ্বীপ প্রজ্বালন, মঙ্গল রথযাত্রাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে।
মারমা সম্প্রদায় জানায়, তিন মাস বর্ষাবাস (উপোস) থাকার পর পাহাড়ি মারমা সম্প্রদায়ের লোকজন ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে (প্রবারণা পূর্ণিমা) উৎসব পালন করে আসছে বহুকাল ধরে। প্রচলিত আছে, বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা গৌতম বুদ্ধ এই আশ্বিনী পূর্ণিমায় তাঁর মাথার চুল আকাশে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাই আশ্বিনী পূর্ণিমার এই তিথিতে আকাশে উড়ানো হয় শতশত ফানুস বাতি। পাহাড়ের মারমা সম্প্রদায় নিজস্ব সামর্থ্য অনুযায়ী ফানুস বাতি বানিয়ে আকাশে উড়িয়ে বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা গৌতম বুদ্ধকে স্মরণ করে।
মারমা সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, আকাশে উঠার আগেই যে ব্যক্তির ফানুস মাটিতে পড়ে যায় পাহাড়িরা তাঁকে পাপী লোক হিসেবে চিহ্নিত করে। ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে উৎসবে ফানুস উড়িয়ে পাহাড়িরা নিজেদের পাপ মোচন ও পাপী মানুষ খুঁজে বের করে।
এ কারণে ফানুস আকাশে উড়ানোর সময় পাহাড়িরা মারমা ভাষায় ‘সাও দো’, ‘সাও দো’ বলতে থাকে। অর্থাৎ শুভ মুক্তি। পাহাড়ি পল্লীগুলো এবং ক্যায়াং থেকে রং-বেরঙের শতশত ফানুস বাতি উড়ানো হয়। অপরদিকে ওয়াগ্যোয়াই পোয়েকে ঘিরে বান্দরবানে পাহাড়ি পল্লীগুলোতে ধুম পড়েছে পিঠা তৈরির। পাহাড়ি তরুণ-তরুণী সারিবদ্ধভাবে বসে হরেক রকমের পিঠা তৈরি করে পাড়া-প্রতিবেশীদের বাড়িতে বাড়িতে বিতরণ করে এ উৎসবে।
ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে মঙ্গল রথযাত্রা। বিশাল আকৃতির ময়ূর তৈরি করে তার ওপর একটি বুদ্ধ মূর্তি স্থাপন করে রথটি টেনে টেনে পুরো শহর ঘুরিয়ে সাঙ্গু নদীতে বিসর্জন দেওয়া হয়। এ সময় বৌদ্ধ ধর্মের নর-নারীরা মোমবাতি জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা জানায় বুদ্ধ মূর্তিকে। রাতের এ রথযাত্রা দেখতে রাস্তার দুই পাশে উপচেপড়া ভিড় জমে।
ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে উৎসব উদযাপন কমিটির সভাপতি হ্লামং মারমা জানান, ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে হচ্ছে মারমা সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। উৎসবকে ঘিরে আজ রোববার থেকে তিন দিনব্যাপী মূল অনুষ্ঠানমালা শুরু হয়েছে। তবে পাহাড়ি পল্লীগুলোতে ফানুস বাতি উড়ানো এবং পিঠা তৈরিসহ বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানমালা চলছে কয়েকদিন আগে থেকেই। এবারও উৎসব আয়োজন কমিটি এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ফানুস বাতি উড়ানো, মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বালন, পিঠা উৎসব, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে খাদ্য ও বস্ত্র বিতরণ এবং ময়ূর রথযাত্রা ও বির্সজন অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে।