শেষ হলো ৯ দিনব্যাপী জামাই মেলা
নানা আয়োজনের মধ্যদিয়ে শেষ হলো নয় দিনব্যাপী জামাই মেলা। গত ১৭ ডিসেম্বর শুরু হয়ে গতকাল বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) রাতে জমকালো কনসার্ট ও র্যাফেল ড্রয়ের মধ্য দিয়ে এই মেলা শেষ হয়।
জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলায় তিন বছর ধরে আয়োজন করা হয় এই ‘জামাই মেলা’। এ বছর সাত দিনব্যাপী জামাই মেলা উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দর্শনার্থী ও ব্যবসায়ীদের অনুরোধে আরও দুই দিন বাড়িয়ে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয় মেলার সময়সীমা।
এই মেলাকে ঘিরে উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের দেড় শতাধিক গ্রামে গেরস্থের বাড়িতে বাড়িতে শুরু হয় মেয়ে-জামাই নিয়ে উৎসবের আমেজ। বিশাল এলাকাজুড়ে বসা এই মেলায় বিনোদনের পাশাপাশি গ্রামীণ ঐতিহ্যের সব কিছুর সঙ্গে গেরস্থের প্রয়োজনীয় তৈজসপত্রের পসরা নিয়ে বসে দোকানিরা। বসে মাছ, মাংস আর নানা রকমের মিষ্টির দোকানও। এবারের মেলায় প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার বেচাকেনা হয়েছে বলে জানা গেছে আয়োজকদের সূত্রে। সমাগম ঘটেছিল কয়েক লাখ দর্শনার্থীর।
উপজেলার যমুনা নদী তীরবর্তী ইউনিয়ন চরপাকেরদহের তেঘরিয়া কালিবাড়ি মাঠে গত ১৭ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় এই ‘জামাই মেলা’। মেলাকে ঘিরে উপজেলার চরপারকেরদহ ছাড়াও বালিজুড়ি, কড়ইচড়া, গুনারীতলা এবং পাশের বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি উপজেলার চালিয়াবাড়ী ইউনিয়নের দেড় শতাধিক গ্রামে যেন উৎসবের আমেজ বিরাজ করে। এসব গ্রামের গেরস্থরা মেলা উপলক্ষে নাইওর নিয়ে আসে মেয়ে আর জামাইকে। এই কদিন মেয়ে আর জামাইকে নানা উপহার, সালামি দেওয়া ছাড়াও সব ধরনের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়।
এই উৎসব আনন্দে শরিক হতে দূর-দূরান্তে বিয়ে দেওয়া মেয়ে আর জামাইরা অপেক্ষায় থাকে সারা বছর। মেলা উপলক্ষে শ্বশুড়বাড়ি এসে সবকিছুকে ছাড়িয়ে জামাইরা মন ভরে উপভোগ করে শ্বশুড়বাড়ির আদর-আপ্যায়ন। পারিবারিক মেলবন্ধন আর জামাই আপ্যায়নের নতুন প্রথা চালুর উদ্দেশ্য নিয়ে তিন বছর ধরে এই মেলার প্রচলন শুরু করেছে স্থানীয়রা।
প্রথম বছর ‘জামাই মেলা’ জমে না উঠলেও গেল বছর থেকে বেশ জাঁকজমকপূর্ণ ভাবেই জমে উঠে এই মেলা। মেলায় গেরস্থের মেয়ে আর জামাই ছাড়াও দূর-দূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়ে সকাল থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত সরগরম থাকে মেলা প্রাঙ্গণ।
ব্যতিক্রমী এমন মেলার আয়োজন করায় উচ্ছ্বসিত মেয়ে জামাইসহ আগত দর্শনার্থীরা। বিশেষ করে শ্বশুর-শাশুড়ির কাছ থেকে পাওয়া সালামি নিয়ে জামাইরা মেলায় আসে বড় মাছ, মাংস আর উপহার সামগ্রী কিনতে। মেলার বড় মাছ কিনে শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য জামাইদের মধ্যে চলে এক ধরনের অদৃশ্য প্রতিযোগিতা। আর দূর-দূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীরা স্থানীয়দের মেয়েজামাই আপ্যায়নের এমন প্রথায় উচ্ছ্বসিত।
এবার বিশাল এলাকাজুড়ে বসা এই মেলায় গ্রামীণ ঐতিহ্যের সবকিছুর সঙ্গে নাগরদোলা, চড়কি, নৌকা দোল, ট্রয় ট্রেন, গেরস্থের প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র, চুড়ি-মালা, কসমেটিক্স ছাড়াও সামুদ্রিক মাছ চিতল, কোরাল, আইড়, কালিবাউশ, রূপচাঁদা, গুলসা, রুই, কাতলা, বোয়াল, মাংস, পান-সুপারিসহ, বালিশ মিষ্টি, রসগোল্লা, চমচম, সন্দেশ, হাসিখুশি মিষ্টি, খাজা, জিলাপি, নানা রকমের মিষ্টির পসরা নিয়ে বসে দোকানিরা।
এবারের মেলায় হরেকরকম পণ্যের পাশাপাশি বিনোদনের জন্য ছিল ঘোড়াদৌড়, মইদৌড়, লাঠিখেলা, শিশুদের জন্য নাগরদোলা, চরকি, দোলনাসহ নানা আয়োজন। জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ও আশপাশের জেলা থেকেও অনেক দর্শনার্থীরা মেলায় যোগ দেয়। প্রতিদিন মেলায় র্যাফেল ড্র এবং খ্যাতিমান শিল্পীদের নিয়ে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অয়োজন করে মেলা কর্তৃপক্ষ। আর গেল বছরের চেয়ে এ বছর মেলায় দর্শনার্থীর উপস্থিতি বেশি থাকায় বেচাবিক্রিও ভালো ছিল বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। ‘জামাই মেলায়’ প্রায় সাড়ে তিনশ স্টলে কেনাবেচা হয়।
জামাই মেলার আয়োজক কমিটির প্রধান সমন্বয়ক মুখলেছুর রহমান মুখলেছ জানান, পারিবারিক মেলবন্ধন তৈরির উদ্দেশ্যেই মূলত এই মেলার আয়োজন। আর এই মেলাকে ঘিরে প্রতি বছর স্থানীয়রা জামাইদের দাওয়াত করে নিয়ে আসে। মেলায় বিনোদনের পাশাপাশি গ্রামীণ ঐতিহ্যের সবকিছুর সঙ্গে গেরস্থের প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র ছাড়াও মাছ, মাংস আর নানা রকমের মিষ্টির পসরা নিয়ে বসেন দোকানিরা। নয় দিনব্যাপী মেলায় সাড়ে তিন কোটি টাকার বেশি বেচাকেনা হয়েছে।
মুখলেছুর রহমান মুখলেছ বলেন, এ বছর জামাই মেলা বেশ ভালোভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ক্রেতা-বিক্রেতাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আগামীতে মেলা আরও জমকালো ও উন্নত করা হবে।