মোহাম্মদ আলী : নিজের খেলা ও দেশকে বদলেছেন যিনি
সদ্য প্রয়াত কিংবদন্তি মার্কিন মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদের যুগে। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে গণ্য হতেন। বর্ণবাদী যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলের অঙ্গরাজ্যে বসবাসকারী কালো মানুষরা আরো কুৎসিত এবং মাঝেমধ্যে বীভৎস অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতেন।
বিবিসি জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদবিরোধী নেতা রেভারেন্ট মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র দেশটির কালো মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করেছেন। নোবেল পুরস্কার জেতা এই কৃষ্ণাঙ্গ নেতাকে অনেকেই যথেষ্ট আক্রমণাত্বক বলে মনে করেন না। ১৯৬৩ সালে সিডনি পোইটিয়ার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে অস্কার জয় করেন। এর পরও ডেট্রয়েটের বেকার কৃষ্ণাঙ্গদের কাছে বিষয়টি অর্থহীন। তবে ১৯৬৪ সালে সনি লিস্টনকে হারিয়ে মোহাম্মদ আলীর হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হওয়া কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিনিদের মধ্যে আলাদা মনোবল সঞ্চার করে।
তৎকালীন ক্লেসিয়াস ক্লে (আলী) নিজেকে ঘোষণা করেন, ‘আমিই সর্বসেরা।’ যুক্তরাষ্ট্রের কালো মানুষদের অধিকারহীনতার যুগে একজন কৃষ্ণাঙ্গর এমন গর্ব শুধু কালোদের মধ্যেই চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেনি, এটি ছিল কর্তৃপক্ষের প্রতিও ভিন্ন রকম বার্তা। মোহাম্মদ আলীর বার্তা কালো মানুষের মধ্যে প্রাণশক্তির সঞ্চার করে।
মোহাম্মদ আলীর দীর্ঘ সময়ের বন্ধু এবং নাগরিক অধিকারকর্মী আল শার্পটন বলেন, ‘আমাদের যুগে সে (আলী) এটিকে সত্য করেছে।’ তিনি আরো বলেন, সে অনেককেই অনুপ্রাণিত করেছে। আল শার্পটন নিজে ঠিক করেছিলেন আলীর মতো হবেন। তিনি বলেন, ‘ধর্ম প্রচারকের পোশাক পরে কারাগারে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার ছিল না।’
বিবিসি জানায়, মোহাম্মদ আলীই হলেন প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন ক্রীড়াবিদ, যিনি সংস্কার ভেঙে দেন। এর আগে একই রকম বিদেশের মাটিতে এমন কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন মার্কিন ক্রীড়াবিদ জেসি ওয়েন। বার্লিন অলিম্পিকে হিটলারের দম্ভ চুরমার করে জিতেছিলেন সোনা।
১৯৬৪ সালে ইসলামী সংগঠন নেশন অব ইসলামে যুক্ত হন মোহাম্মদ আলী। পরে ১৯৭৫ সালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তাঁর ক্লেসিয়াস ক্লে থেকে পরিবর্তিত হয়। নেশন অব ইসলামের তৎকালীন নেতা এলিজা মোহাম্মদ এবং ম্যালকম এক্স (আলহাজ মালিক এল-শাবাজ) ছিলেন প্রচণ্ড শ্বেতাঙ্গবিরোধী। সাদা মানুষদের শয়তান হিসেবে গণ্য করতেন তাঁরা। অহিংস কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার আন্দোলনকারী মার্টিন লুথার কিংয়ের সঙ্গে ঘোর বিরোধ ছিল ম্যালকম এক্সের। ম্যালকমের দর্শনের অনুসারী হলেও একই সঙ্গে লুথার কিংয়ের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক ছিল মোহাম্মদ আলীর।
তৎকালীন অনেক নেতার মতে, ক্রীড়াবিদ ও অধিকারকর্মী মোহাম্মদ আলী ম্যালকম এক্স এবং লুথার কিংকে জনসমক্ষে জড়িয়ে ধরার মতো মানসিকতাসম্পন্ন ছিলেন।
শুধু কৃষ্ণাঙ্গ অধিকারের পক্ষে সোচ্চার বলেই মোহাম্মদ আলী বিখ্যাত নন। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন ঘোর যুদ্ধবিরোধী। ১৯৬৭ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। এটি তাঁকে তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বিখ্যাত যুদ্ধবিরোধী ব্যক্তিত্বে পরিণত করে। ওই প্রত্যাখ্যানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালত তাঁকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড দেন। কেড়ে নেওয়া হয় তাঁর চ্যাম্পিয়ন পুরস্কার। তবে কারাগারে না গেলেও সাড়ে তিন বছর মুষ্টিযুদ্ধ থেকে দূরে ছিলেন আলী। ১৯৭১ সালে সুপ্রিম কোর্ট আলীর ওপর থেকে খেলার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন।
মোহাম্মদ আলীর দীর্ঘ সময়ের বন্ধু আল শার্পটন বলেন, আলী এমন সময় ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন যখন যুক্তরাষ্ট্রে কিছুটা হলেও ওই যুদ্ধের পক্ষে সমর্থন ছিল। মোহাম্মদ আলী যুদ্ধে বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তাঁর সব অর্জন ঝুঁকির মুখে ফেলেন। নিজের দর্শনের জন্য সবকিছু বিসর্জন দিতে তৈরি ছিলেন মোহাম্মদ আলী, যা তাঁকে নিয়ে গেছে ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের চেয়ে অনন্য উচ্চতায়।
জীবনের শেষ দিকে আলীর দর্শনের কিছুটা পরিবর্তন হয়। ন্যাশন অব ইসলামের বর্ণবাদের বিভক্তি থেকে সরে যান তিনি।
বিবিসির দৃষ্টিতে আলী একজন ক্রীড়াবিদ, যিনি শুধু ক্রীড়ারই পরিবর্তন ঘটানটি; একই সঙ্গে অধিকারকর্মী হিসেবে পরিবর্তন ঘটিয়েছেন দেশের।