‘একজন আমাকে পাড়া দিয়ে ধরত, অন্যজন মারত’
‘শাহাদাত হোসেনের বৌ কাঠের খুন্তিতে গরম তেল নিয়ে আমার হাঠুতে ছ্যাকা দেয়। একদিন রাতে আমি বাচ্চার সুজি রান্না করছিলাম। দেরি হয়েছে বলে শাহাদাত ও তাঁর বৌ আমাকে মারতে শুরু করে। শাহাদাতও বেলন নিয়ে এসে আমাকে মারধর করে। আমার ডান পায়ের হাঁটুর নিচে বেলন লাটির একটি অংশ লেগে গর্ত হয়, রক্ত বের হয়। এতে তাঁরা মারা থামায়। ক্ষততে ন্যাকড়া বেঁধে আমি কাজ করি। ঐ রাতে আমি ভয়ে তাদের কথামত ঘরের সব কাজ করি।’
আজ বুধবার ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ৫-এর বিচারক তানজিনা ইসমাইলের আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় ঢাকা মহানগর হাকিম স্নিগ্ধা রানী চক্রবর্তী ভিকটিম মাহফুজা আক্তার হ্যাপীর ২২ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ড করার কাগজ উপস্থাপন করেন। ঢাকা মহানগর হাকিম স্নিগ্ধা রানী চক্রবর্তী গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর সে জবানবন্দি রেকর্ড করেন। আজ জবানবন্দিটি প্রদর্শনী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং বিচারক তা গ্রহণ করেছেন।
জবানবন্দিতে হ্যাপী আরো বলেছে, ‘আমি ক্রিকেটার শাহাদাতের বাসায় প্রায় এক বছর যাবৎ কাজ করি। আমাকে দুই হাজার টাকা বেতন দিত। আমি বাসার সব কাজ করতাম। আমার কাজে কোনো ভুল হলেই শাহাদাত আর তার বৌ আমাকে মারত।’
‘একজন পা দিয়ে আমাকে পাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত, অন্যজন মারত। সারা শরীরেও লাঠি দিয়ে মারত। আমার পাছায় বেশি মারত। আবার মারার জায়গায় বরফ দিয়ে ধরে রাখতো সারা রাত। আমি বরফ সরালে তাঁরা আবার পিটাত। আমার বরফ ধরে রাখতে কষ্ট হতো।’
‘প্রায়ই শাহাদাত হোসেন আমার গলা টিপে ধরত। আমার শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে আমি শ্বাস নিতাম। তখন আমাকে আরো মারত।’
‘তাঁর (শাহাদাত) বৌ মাঝে মাঝে আমার গলা টিপে ধরেছে। আমাকে ডাল ঘুটনি দিয়ে মারতে মারতে চার-পাঁচটি ডাল ঘুটনি ভেঙ্গে ফেলেছে। আমাকে ভাতের চামচ দিয়ে মারত। ভাতের চামচ অনেক মেরে ভেঙ্গেছে।’
‘রুটি বানানোর বেলন দিয়ে মারত। আমি ওটা লুকিয়ে রেখেছিলাম বলে ওরা আরো একটি বেলন কিনে আনছে। শাহাদাত হোসেনের বৌ কাঠের খুন্তিতে গরম তেল নিয়ে আমার হাঠুতে ছ্যাকা দেয়।’
‘একদিন রাতে আমি বাচ্চার সুজি রান্না করছিলাম। দেরী হয়েছে বলে শাহাদাত ও তার বৌ আমাকে মারতে শুরু করে। শাহাদাত ও বেলন নিয়ে এসে আমাকে মারধোর করে। আমার ডান পায়ের হাঁটুর নিচে বেলন লাটির একটি অংশ লেগে গর্ত হয়, রক্ত বের হয়। এতে তারা মারা থামায়। ক্ষততে ন্যাকড়া বেঁধে আমি কাজ করি।ঐ রাতে আমি ভয়ে তাদের কথামত ঘরের সব কাজ করি।’
‘শাহাদাত তাঁর বৌকেও মারত। আমার চোখে মুখে ঘুষি দিত। আমার বাঁ চোখ ফুলে প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। একদিন শাহাদাতের বৌ আমাকে মুখ চেপে ধরে মারত।’
‘সে একদিন আমার মুখ চেপে ধরতে গিয়ে তাঁর নখ আমার বা গালে লেগে দাগ হয়ে যায়। পরের দিন শাহাদাৎ হোসেন আমার বা গালে চড় মারলে দাগ পড়ে যায়।’
‘তাঁর নখ লেগেও বাম গালে দাগ হয়। তারা আামাকে ঠিক মতো খেতে দিত না। তাদের উচ্ছিষ্টগুলো আমাকে খেতে দিত। আমি শেষ ঘটনার কয়েকদিন আগে আসামিদের দেশের বাড়িতে যাই।’
‘সেখানে আমি শাহাদাত হোসেনের মায়ের কাছে নালিশ করি। তিনি আমাকে মারতে নিষেধ করেন। সেই রাতে আসামিরা ঢাকায় আসার পথে গাড়িতে শাহাদাত হোসেনের বৌ আমাকে পানির বোতল দিয়ে মারে।’
‘গাড়িতে আমাকে মারার জন্য তিন চারটা লাঠি ছিল। গাড়িতে আমাকে সে চর ও ঘুষি মারে। এর পরই সুজি রান্নার ঘটনা নিয়ে শাহাদাতের বৌ আমাকে পাড়া দিয়ে ধরে। আমি চিৎকার করি সে জন্য আমার মুখে পাতা দিয়েছিল, মেরেছিল। মারের কারণে আমার বাম হাতের আঙ্গুল ভেঙ্গে গেছে।’
‘প্রায় দুই সপ্তাহ আগে একদিন দুপুরের দিকে বাচ্চার সুজির রং হলুদের কারণ জিজ্ঞাসা করে শাহাদাতের বৌ। আমি ভয়ে মিথ্যা বলি যে সুজিতে আমি হলুদ মিশাইছি। শাহাদাৎ হোসেন তখন প্রেকটিসে ছিল। তাঁর বৌ এটা নিয়ে আমার পেটে ঘুষি মারে। আমাকে মারার জন্য একটি লাঠি কিনে আনতে বলে।’
‘আমি ভয়ে গেট খুলে বাসা থেকে বের হয়ে ৬নং বাজারের সামনে যাই। সেখানে একজন মেয়ে আমাকে কী হয়েছে জিজ্ঞেস করে।আমি তাকে সব ঘটনা খুলে বলি। সে আমাকে সাংবাদিকের কাছে নিয়ে যায়।এর পর আমাকে ডাক্তার দেখানো হয়।এক্স-রেতে দেখা যায়, আমার বাম পা ভেঙ্গে গেছে। তারা আমাকে সবসময় তালা দিয়ে আটকে রাখত। রাতে বাথরুমে ঘুমাতে দিত।’
মহানগর হাকিমের সাক্ষ্যের পর তাঁকে জেরা করেন শাহাদাতের আইনজীবী কাজী নজিবুল্লাহ হিরু। পরে বিচারক আগামী ২৪ আগস্ট এ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য দিন ধার্য করেছেন। ওই দিন ভিকটিম ও মামলার বাদীকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য দিন রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ৫-এর সরকারি কৌঁসুলি আলী আজগর স্বপনের কাছে জানতে চাইলে, তিনি এ প্রতিবেদকের সাথে খারাপ আচরণ করেন। কোনো তথ্য তাঁর কাছে জানতে নিষেধ করেন। না হলে তিনি ‘চাকরি খেয়ে ফেলবেন’ বলে প্রতিবেদককে হুমকি দেন।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি এ মামলায় শাহাদাত ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে এ মামলায় অভিযোগ গঠন করা হয়।
গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও মিরপুর মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শফিকুর রহমান তাঁদের বিরুদ্ধে ঢাকার সিএমএম আদালতে এ অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এ মামলায় বর্তমানে তাঁরা দুজনই জামিনে রয়েছেন।
গত বছরের ৫ অক্টোবর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে শাহাদাত আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করলে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।
অন্যদিকে স্ত্রী নিত্যকে গত ৪ অক্টোবর ভোরে দিবাগত গভীর রাত সাড়ে ৩টায় মালিবাগের পাবনা গলিতে তাঁর বাবার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে মিরপুর মডেল থানা পুলিশ।
গত ৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মিরপুর মডেল থানায় ক্রিকেটার শাহাদাত তাঁর বাসার গৃহকর্মী মাহফুজা আক্তার হ্যাপীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মর্মে একটি জিডি করেন। এরপর একই দিন রাত ৮টার দিকে মিরপুরের পল্লবী এলাকা থেকে হ্যাপীকে উদ্ধার করে পুলিশ।
এরপর তাকে মিরপুর থানায় নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে হ্যাপী অভিযোগ করে শাহাদাতের বাসায় তার ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হতো।
পরে পুলিশ হ্যাপীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি করে। একই সঙ্গে সাংবাদিক খোন্দকার মোজাম্মেল হক শিশু নির্যাতনের দায়ে শাহাদাতের নামে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা করেন।
এরপর থেকেই শাহাদাত স্ত্রীসহ পলাতক ছিলেন।