আপনারা কি আপনাদের দায়িত্ব পালন করতে পারছেন?
দেশের প্রতিটি আইন ত্রুটিপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। তিনি বলেছেন, ত্রুটিপূর্ণ আইনের কারণে বিচার করতে গেলেই তাঁরা খেই হারিয়ে ফেলছেন। এ কারণে মামলার জটও বাড়ছে।
বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে মৌলভীবাজার পৌর জনমিলন কেন্দ্রে জেলা আইনজীবী সমিতির বার্ষিক নৈশভোজ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন প্রধান বিচারপতি।
সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, ‘আমাদের মাননীয় সংসদ সদস্য একজন মহিলা, আমি পত্রিকা পড়ে দেখলাম। উনি বলেছেন, উনি (প্রধান বিচারপতি) এত কথা বলেন কেন? উনি শুধু মামলার শুনানি করবেন এবং রায় লিখবেন। আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে মাননীয় সংসদ সদস্যকে বলছি, আমি একটুও কথা বলতে চাই না। কিন্তু আপনারা কি আপনাদের দায়িত্ব পালন করতে পারছেন? আইন প্রণয়নে আজকে, দেশে প্রতিটি আইন আপনার, বিচার করতে গেলেই আমরা খেই হারিয়ে ফেলি। কোনো আইনই আমরা ঠিকমতো পাচ্ছি না। প্রতিটি আইন ত্রুটিপূর্ণ। এই ত্রুটিপূর্ণ আইন হওয়ায় সেই সুযোগে মামলা বেড়ে যাচ্ছে।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘গত ইউনিয়ন পরিষদে একটা ইলেকশন হয়ে গেল। সেখানে এত ত্রুটিপূর্ণ আইন ছিল, মামলা আয়ত্তে ছিল না। যার পরিপ্রেক্ষিতে হাজার হাজার মামলার রিট ফাইল হলো হাইকোর্টে। দায়িত্বটা বিচার বিভাগের ওপর অর্পিত হয়। আপনারা যদি এই দায়িত্বগুলা ঠিকমতো পালন করতে পারতেন, তাহলে বিচার বিভাগের ওপর দায়িত্ব আসত না। আপনারা যদি বিচার বিভাগের যে দায়িত্ব, কর্তব্য—এই কর্তব্যে হস্তক্ষেপ না করেন, আপনারা যদি বিচার বিভাগকে বিচার বিভাগের কাজ করতে দিতেন, তাহলে কিন্তু আজকে এই হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মামলার জট পাকত না।’
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের জন্য সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েন
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমাদের দেশে যে আমেরিকার অ্যাম্বাসাডর (রাষ্ট্রদূত) আছেন, উনি চতুর্থ, না হয় পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ ক্যাটাগরির অ্যাম্বাসাডর। তাঁর কিন্তু আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার, দেখা করে কথা বলার অধিকার নাই। সেই অ্যাম্বাসাডর যখন বাংলাদেশের কোথাও যায়, আমাদের মিডিয়া, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ হুমড়ি খেয়ে পড়েন।…প্রকৃতপক্ষে সে এত নিচুস্তরের কর্মকর্তা, সেই আমেরিকা কেন? সেই দেশে আইনের শাসন আছে। সেই দেশের সম্পদ আছে, সে দেশের জ্ঞানের ভাণ্ডার কী নেই? এক লাঠিতে সারা পৃথিবীকে ঘোরাচ্ছে। যা বলছে প্রত্যেকে শুনছে। এটা কিন্তু একদিনে হয়নি।’
সব ঠিক করে দিচ্ছে বিচার বিভাগ
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বিচার বিভাগকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। আজকেও আপনারা আমেরিকায় দেখেন, আপনারা চোখ বুলান আমেরিকাতে, বিচার বিভাগকে নিয়ে কথা উঠছে। এই বিচার বিভাগ কিন্তু ঠিক করে দিচ্ছে এই যে তাদের ইমিগ্রেশন, ইয়েগুলোকে রক্ষা করে দিচ্ছে। ফেডারেল আপিল কোর্টে সবাই চেয়ে আছে, ওখানে কী রায় দেবে, এরপর সুপ্রিম কোর্টে কী হবে। সারা দেশে, সারা পৃথিবীর মানুষ তাকিয়ে আছে আমেরিকার বিচার বিভাগের দিকে। দেশে যখন ক্রান্তিলগ্ন হয়, তখন কিন্তু বিচার বিভাগই সেই দেশকে রক্ষা করে।’
পুলিশের তদন্ত ও প্রসিকিউশনে অনেক ত্রুটি
প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের সঙ্গে পুলিশ বিভাগের অঙ্গাঙ্গি সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমরা বিচার করতে গিয়ে বিচার করতে পারছি না এবং বিচারে অনেক ত্রুটি পাচ্ছি। এমন কিছু মামলা আমরা পাচ্ছি, যে সব মামলা একেবারে গুরুত্বপূর্ণ মামলা, সেনসেশন মামলা। কিন্তু অনেক ত্রুটি ইনভেস্টিগেশনে পাচ্ছি, প্রসিকিউশনে ত্রুটি পাচ্ছি। আমি বাধ্য হয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে গিয়েছিলাম। সবাইকে যেসব ত্রুটি পাচ্ছি সেগুলো বলার জন্য। আমি এখনো বলছি, পুলিশ প্রশাসনে ত্রুটি আছে এবং তাদের ইনভেস্টিগেশনে ত্রুটি আছে। আমার বিচার বিভাগ থেকে যদি কোনো সহযোগিতা চায়, আমি যেকোনো জায়গায় গিয়ে তাদের কাছে বক্তৃতা দিতে চাই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদেরকে আমি ব্যাখ্যা করব এবং ইদানীং আমি কয়েকটা রায়ও পাঠিয়েছি যেগুলোর ত্রুটি, এত সূক্ষ্ম জিনিস যে এগুলো তাদের এক্সপেরিমেন্ট করা উচিত, মূল্যায়ন করা উচিত।’
মৌলভীবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. কামাল উদ্দিন আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক কামরেল আহমেদ চৌধুরীর পরিচালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন সংসদ সদস্য সৈয়দা সায়রা মহসীন, হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার সৈয়দ দিলজার আহমদ, জেলা ও দায়রা জজ শফিকুল ইসলাম, জেলা প্রশাসক মো. তোফায়েল ইসলাম, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাহ জালাল প্রমুখ।