এমপি হতে লিটনকে হত্যা, বছর ধরে পরিকল্পনা!
ক্ষমতার উচ্চাভিলাষী লোভ এবং আবার সংসদ সদস্য (এমপি) হওয়ার জন্য গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগের এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে হত্যা করা হয়। আর এক বছর ধরে এর পরিকল্পনা করেন ওই আসনে জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি ও সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ডা. মো. আবদুল কাদের খান। তাঁর অর্থায়নে এমপি লিটনকে হত্যা করা হয়।
আজ বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে গাইবান্ধা জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি করেন পুলিশের রংপুর রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) খন্দকার গোলাম ফারুক।
ম্যাগাজিন থেকে হত্যা রহস্য উন্মোচন!
সংবাদ সম্মেলনে ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ‘আপনারা জানেন যে এই সুন্দরগঞ্জে ২ ডিসেম্বর মানে এমপি সাহেব (মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন) মারা যাওয়ার প্রায় ২৮-২৯ দিন আগে ওই এলাকায় একটি ছিনতাই হয়েছিল। ওই ছিনতাইয়ের সময় সন্ত্রাসীরা একটি ম্যাগাজিন ফেলে রেখে যায়। ওই ম্যাগাজিনে যে গুলি পাওয়া যায় আর এমপি (মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন) সাহেবের শরীরে যে গুলির খোসা পাওয়া যায়, একই গুলি। এই সূত্র ধরে আমরা ওই ছিনতাইকারীদের সন্ধান করতে থাকি। অন্যান্য বিষয়ে তদন্তের পাশাপাশি ওই বিষয়টাও আমরা তদন্ত করতে থাকি। তদন্ত করতে করতে একপর্যায়ে আমরা ওই ছিনতাইকারীদের পরিচয় জানতে পারি। এই পরিচয়ের সূত্র ধরে তাদের একপর্যায়ে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হই। গতকাল তারা আদালতে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে, কারা কীভাবে মাননীয় সংসদ সদস্য মহোদয়কে হত্যা করেছে।’
সংবাদ সম্মেলনের এই পর্যায়ে ডিআইজি এমপি লিটন হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করেন। ডিআইজি বলেন, ‘আমরা যে নামগুলো পেয়েছি, গতকাল তিনজন আদালতে ১৬৪ করেছে। মেহেদী হাসান, শাহীন ও হান্নান। এই তিনজন আদালতে ১৬৪ করেছে এবং আরেকজন কিলার তাদের সাথে ছিল। রানা। এই রানাও আমাদের নজরাধীন আছে। রানাও যেকোনো মুহূর্তে গ্রেপ্তার হয়ে যাবে। তিনজন মূল কিলিংয়ে (হত্যাকাণ্ড) ছিল।’
এঁদের মধ্যে শাহীন আবদুল কাদের খানের ভাতিজা, হান্নান তাঁর গাড়িচালক ও মেহেদী ব্যক্তিগত সহকারী।
এক বছর ধরে হত্যার পরিকল্পনা!
ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ‘আর এই পুরো ঘটনার (এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যাকাণ্ড) পেছনে, আমাদের প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণ করে, কিলার গ্রুপের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং আমাদের অন্যান্য সাক্ষ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণ করে আমরা যে জিনিসটা পাইলাম এই ঘটনার পেছনে মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন সুন্দরগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য ডা. কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) আবদুল কাদের খান। ওনার পরিকল্পনায়, ওনার অর্থায়নে এই ঘটনাটা ঘটেছে। এবং উনি প্রায় এক বছর ধরে পরিকল্পনাটা করে আসছিলেন যে এমপি লিটনকে কীভাবে সরিয়ে দেওয়া যায়। কারণ ওনার একটা ধারণা ছিল উনি এই এলাকার এমপি ছিলেন। যদি লিটন মহোদয় না থাকেন, তাহলে উনি আবার এলাকার এমপি হতে পারবেন। এই ধরনের লোভের বশবর্তী হয়ে এবং ক্ষমতার লোভে; আমি বলব ক্ষমতার লোভ এবং উচ্চাভিলাষী ক্ষমতার লোভ। এই কারণে উনি এক বছর ধরে পরিকল্পনা করে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে কন্টাক্ট করেছেন। সর্বশেষ যে গ্রুপটা আমাদের হাতে ধরা পড়ল, ছয় মাস যাবৎ এই গ্রুপটাকে উনি ট্রেনিং দিয়ে লালন-পালন করে এদেরকে দক্ষ গড়ে তুলেছেন। আমরা পরিকল্পনাকারী কর্নেল অবসরপ্রাপ্ত কাদের খানকে গতকাল (মঙ্গলবার) ওনার বগুড়ার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করেছি এবং এখন আমাদের হেফাজতে আছে। আমরা বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ডে নিয়ে আসব। জিজ্ঞাসাবাদ করব। আরো কোনো তথ্য যদি থাকে আমরা তদন্তের ক্ষেত্রে ব্যবহার করব।’
ডিআইজি আরো বলেন, আবদুল কাদের খানের পরবর্তী টার্গেট ছিল একই আসনের জাতীয় পার্টির সম্ভাব্য প্রার্থী শামীম হায়দার পাটোয়ারী। মূলত সুন্দরগঞ্জ আসনে উপনির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়ের জন্য এমপি লিটনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়।
আবদুল কাদের খান গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসন থেকে জাতীয় পার্টির মনোনয়নে ২০০৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁর বাড়ি সুন্দরগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম ছাপরহাটি (খানপাড়া) গ্রামে। তিনি পরিবারসহ বগুড়া জেলা শহরের রহমাননগরের চারতলা বাসভবনে থাকেন। ওই বাসভবনে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. কর্নেল (অব.) আবদুল কাদের খানের গরীব শাহ ক্লিনিক রয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে কাদের খান জাতীয় পার্টির মনোনয়ন পাননি। সেখান থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন।
গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টার দিকে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নে শাহবাজ (মাস্টারপাড়া) এলাকায় নিজ বাড়িতে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন। এ ঘটনায় লিটনের বোন তাহমিদা বুলবুল বাদী হয়ে অজ্ঞাত চার-পাঁচজনকে আসামি করে ১ জানুয়ারি সুন্দরগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা করেন।
মামলায় এ পর্যন্ত আবদুল কাদের খানসহ ১১০ জনকে আটক করে পুলিশ। এর মধ্যে ২৪ জনকে ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে।