অপারেশন টোয়াইলাইট শেষে সেনাবাহিনী যা বলল
সিলেটের শিববাড়ির আতিয়া মহলে শেষ হয়েছে সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযান ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’। আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এক সংবাদ ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে তা জানান অভিযানের মুখপাত্র সেনা গোয়েন্দা পরিদপ্তরের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান।
এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন র্যাব ৯-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আলী হায়দার আজাদ আহমেদ, আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাশেদুল হাসান ও সিলেট মহানগর পুলিশের কমিশনার গোলাম কিবরিয়া।
সংবাদ ব্রিফিংয়ের শুরুতে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বলে উপস্থিত সাংবাদিকদের সালাম দিয়ে অভিযানের বিস্তারিত তুলে ধরেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান।
ফখরুল আহসান বলেন, ‘অপারেশন টোয়াইলাইটের ঘটনাবলি, অগ্রগতি ইত্যাদি সম্বন্ধে আমরা বিগত তিনদিন আপনাদেরকে অবহিত করেছি। আপনারা জানেন গত ১৫ মার্চ বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে একটি সফল জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে। ওই অভিযানে প্রাপ্ত তথ্যের সূত্র ধরে তারা চিহ্নিত করে যে সিলেট সিটি করপোরেশনের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের শিববাড়ী পাঠানপাড়া সড়কের পাশে অবস্থিত কোনো এক বাড়িতে জঙ্গিরা লুকিয়ে আছে। গত ২৪ মার্চ রাত আনুমানিক দেড়টার সময় পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা এলাকাটি ঘিরে ফেলে। রাত আনুমানিক সাড়ে ৪টায় তারা নিশ্চিত হন যে ‘আতিয়া মহল’ নামক পাঁচতলা বাড়ির নিচতলার একটি ফ্ল্যাটে জঙ্গিরা অবস্থান করছে। অভিযান পরিচালনাকারী পুলিশ সদস্যরা সঙ্গে সঙ্গে আতিয়া মহলের নিচতলার ছয়টি ফ্ল্যাট বাইরে থেকে বন্ধ করে দেয় এবং ভবনের মূল প্রবেশ পথের কলাপসিবল গেটটি বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দেন। একেই সাথে ভবনটি সব দিক থেকে ঘিরে ফেলে।
পাঁচ তলা বাড়িটির প্রতিটি তলায় ছয়টি করে মোট ৩০টি ফ্ল্যাট আছে। ঘটনার সময় ২৮টি ফ্ল্যাটে বাসিন্দারা তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছিলেন। জঙ্গিরা পুলিশ বাহিনীর উপস্থিতি বুঝতে পেরে তাদেরকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুঁড়ে মারে।
সিলেট পুলিশ বাহিনী জঙ্গিদের সক্ষমতা ও ২৮টি পরিবারের নিরাপত্তা ঝুঁকি বিবেচনা করে তাদের বিশেষ দক্ষতা সম্পন্ন সোয়াটের সহায়তা কামনা করে এবং বাড়িটিকে নিচ্ছিদ্রভাবে ঘিরে রাখে। এ সময়ে ভবনের বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে নিজ নিজ ফ্ল্যাটে দরজা জানালা বন্ধ করে যতটুকু সম্ভব নিরাপদে থাকার চেষ্টা করে। ইতিমধ্যে জঙ্গিরা তাদের ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসে এবং ভবনের মূল ফটকে বিশাল আকৃতির বিস্ফোরক স্থাপন করে। এমনকি একটি ফ্রিজ ও মোটরবাইকও বিস্ফোরক লাগিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। এ ছাড়া পুরো ভবনের সিঁড়িসহ বিভিন্ন জায়গায় বিস্ফোরক স্থাপন করে পুরো ভবনটিকে অতিমাত্রায় বিপজ্জনক করে ফেলে।
ইতিমধ্যে ঢাকা থেকে পুলিশের সোয়াটের সদস্যরা ২৪ মার্চ আনুমানিক বিকেল ৪টার সময় অপারেশন এলাকায় উপস্থিত হন। সোয়াটের সদস্যরা তাদের পর্যবেক্ষণ, পরিকল্পনা ও বিচার বিশ্লেশণ শেষে বাসিন্দাদের নিরাপত্তা, বিস্ফোরক ঝুঁকি ইত্যাদি বিবেচনা করে সেনাবাহিনীর সহায়তা কামনা করেন।
পুলিশ প্রশাসনের অনুরোধে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে সেনাবাহিনী অপারেশনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করে। ১৭ পদাতিক ডিভিশন ও বিশেষায়িত কমান্ডো দল পরের দিন অভিযান শুরু করে। উপস্থিত পুলিশ বাহিনীর নিকট থেকে জানা যায় যে, ভবনের নিচ তলায় তিনজন পুরুষ ও একজন মহিলাসহ মোট চারজন জঙ্গি বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরকসহ অবস্থান করছে। একই সময়ে ঢাকা হতে বিশেষায়িত একটি দলকে হেলিকপ্টার যোগে সিলেটে আনা হয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনার আলোকে সেনাবাহিনী অপারেশন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। অপারেশন মূলত দুটি অগ্রাধিকার বিষয় নির্ধারণ করা হয়। প্রথমত, ভবনের বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া, দ্বিতীয়ত জঙ্গিদের নির্মূল করা।
অপারেশনের প্রথম পর্বটি ছিল সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। কমান্ডোরা তাদের জীবন বাজি রেখে অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে অভিনব কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে ২৫ মার্চ আনুমানিক দুপুর ১টার মধ্যে ভবন থেকে ৩০ জন পুরুষ, ২৭ জন মহিলা ও ২১ জন শিশুসহ মোট ৭৮ জনকে নিরাপদে উদ্ধার করে। মহান আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে ও দেশবাসীর দোয়ায় এ পর্বটি অত্যন্ত সফলভাবে শেষ হয়। এ সময়ের বৈরী আবহাওয়া অপারেশন সফলভাবে শেষ করার জন্য নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। পুরো ভবনের পাঁচতলা থেকে দোতলা পর্যন্ত উদ্ধার কাজ অত্যন্ত সন্তোর্পণে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। নিচতলার উদ্ধার অভিযান ছিল সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। কমান্ডো সদস্যরা অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অভিবন পন্থা অবলম্বন করে সব বাসিন্দাকে নিরাপদে সরিয়ে আনে।
এরপর অভিযান দল তাদের দ্বিতীয় পর্বের তথা জঙ্গিদের নির্মূলের কার্যক্রম শুরু করে। এ পর্বে সেনাবাহিনীর কমান্ডোদের পাশাপাশি স্নাইপার দল এপিসিসহ বিশেষায়িত অনেক সদস্য নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেন। তিন দিন একটানা বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে ২৭ মার্চ বিকেলের মধ্যে চারজন জঙ্গিকে নির্মূল করা হয়। মূলত গতকালই অভিযান শেষ হয়। তবে আরো বিশদ তল্লাশি ও নিশ্চিত হওয়ার জন্য আজকের দিনটি ব্যবহার করা হয়। গতকাল দুটি মৃতদেহ বের করে পুলিশ প্রশাসনের নিকট হস্তান্তর করা হয়। বাকি যে দুটি মৃতদেহ ছিল সেগুলো সুইসাইডাল ভেস্টসহ থাকায় অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিল। নিরাপত্তা বিবেচনায় ও পুলিশ প্রশাসনের পরামর্শে ঘটনাস্থলেই এগুলোর বিস্ফোরণ করা হয়। বিস্ফোরণের আগে প্রয়োজনীয় ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করা হয়। সকল কার্যক্রম শেষে আজ বিকেলে ভবনটি ক্রাইমসিন হিসেবে পুলিশ প্রশাসনের নিকট হস্তান্তর করা হয় এবং ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’-এর সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।
এই পুরো অপারেশন পরিচালনায় পুলিশ, র্যাব, সোয়াট, ফায়ার সার্ভিস, বিভিন্ন সেবা প্রদানকারী সংস্থা, স্থানীয় প্রশাসনসহ এলাকাবাসী যে সহায়তা করেছেন তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। অপারেশন টোয়াইলাইট যে কোনো ক্রাইসিস মোকাবিলায় সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের সমন্বিত প্রচেষ্টার একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে বলে সেনাবাহিনী বিশ্বাস করে।
অপারেশন চলাকালীন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার ভূমিকা ও পেশাদারত্ব আমাদের পরিচালনায় সহায়ক হয়েছে। এজন্য তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সর্বোপরি, মহান আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমত ও দেশবাসীর দোয়ায় এ ধরনের একটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানে অংশগ্রহণকারী সদস্যরা কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া সম্পন্ন করতে পেরেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের যে কোনো বিপদ সংকট পরিস্থিতি মোকাবিলায় অতীতের ন্যায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে সদা প্রস্তুত।’ বলে বক্তব্য শেষ করেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান।