রিভিউতে সাজা পরিবর্তন রেয়ার : সাঈদীর শুনানিতে প্রধান বিচারপতি
মানবতাবিরোধী অপরাধে আমৃত্যু কারাদণ্ড পাওয়া জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার শুনানিকালে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহা বলেছেন, রিভিউতে সাজা পরিবর্তনের ঘটনা রেয়ার (দুষ্প্রাপ্য)।
আজ রোববার রিভিউয়ের শুনানিকালে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের উদ্দেশে এ কথা বলেন প্রধান বিচারপতি।
মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মামলা থেকে খালাস চেয়ে সাঈদী ও সাজা বাড়াতে রাষ্ট্রপক্ষের রিভিউ আবেদনের শুনানি হয় আজ । সেই শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে এস কে সিনহা বলেন,‘এ মামলায় দ্বৈত আদেশ হয়েছে। আমরা সাক্ষ্য-প্রমাণ অনেক যাচাই-বাছাই করে একটি রায় দিয়েছি। আপিল বিভাগ যখন একবার শুনে কাউকে সাজা দেন, রিভিউতে সেটা পরিবর্তন রেয়ার।’
‘এই মুহূর্তে আপনি আর রিভিউ উপস্থাপন করেবেন না। আপনি তো একটি রায় পেয়েছেন। আমরা আগে আসামিপক্ষকে শুনব। রিভিউ হলেই দণ্ড কমবে, তা কিন্তু নয়।’
এর পর দুপুর ১২টার দিকে সাঈদীর পক্ষে আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন খালাস চেয়ে রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি শুরু করেন।
‘মে মাসে বর্ষাকাল থাকে, ওয়াজ হয় না’
রিভিউ শুনানির শুরুতে খন্দকার মাহবুব হোসেন সাঈদীর হয়ে বলেন, ‘মাই লর্ড, ঘটনার সময় আমি (সাঈদী) সেই জায়গায় উপস্থিত ছিলাম না। তা ছাড়া সাক্ষী সুখরঞ্জন বালী নিজেই বলেছেন, তাঁর ভাইকে হত্যার জন্য আমি জড়িত নই। তখন সুখরঞ্জন বালীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন ট্রাইব্যুনাল থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে।’
‘আমরা শুনেছি ওই সাক্ষী ভারতের কারাগারে এখনো জীবিত আছে। ওই সাক্ষীর জবানবন্দি নেওয়া হলে রায় পাল্টে যেতে পারে। তাই ওই আসামিকে হাজির করার আদেশ দেওয়া হোক।’
সাঈদীর আইনজীবীর বক্তব্যের পর প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘রিভিউ শুনানি করার সুযোগ খুবই কম থাকে। আইনি পয়েন্ট থাকলে সেটি উপস্থাপন করেন, মামলার ফ্যাক্ট বলবেন না।’
খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘মাই লর্ড, এ সাক্ষীকে হাজির করা হলে রায় উল্টে যাবে।’
এর কোনো জবাব দেননি প্রধান বিচারপতি। পরে খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন সাঈদী সাহেব পিরোজপুরে ছিলেন না। তিনি তখনো একজন প্রফেশনাল বক্তা ছিলেন। ওয়াজ মাহফিল করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। টিউশনি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তিনি যশোরে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করতেন।’
ওই সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘উনার বিরুদ্ধে অভিযোগ মে মাসের দিকে। আমাদের দেশে মে মাসে তো বর্ষাকাল থাকে। ওই সময় তো ওয়াজ মাহফিল হয় না। সাধারণত ওয়াজ মাহফিল হয় শীতকালে।’
জবাবে সাঈদীর আইনজীবী বলেন, ‘বাংলাদেশের ঋতু পরিবর্তন হয়ে গেছে। ওই সময় মে মাসেও শীতকাল ছিল।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমাদের দেশে মার্চ, এপ্রিল, মে মাসে ওয়াজ মাহফিল হয় না। মে মাস থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সাধারণত বর্ষাকাল থাকে। এ সময় ওয়াজ মাহফিল হয় না। সব জায়গায় রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে থাকে। আর ওই সময় তো বর্তমান সময়ের মতো রাস্তাঘাট এত উন্নত ছিল না।’
খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘১৯৭১ সালে এ দেশের যে ঋতু ছিল, এখন তা নেই।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘মিস্টার খন্দকার সাহেব, আপনি বলেন, উনি ছেলে বউ-বাচ্চা নিয়ে ওয়াজ মাহফিল করার জন্য বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন। এটি কীভাবে সম্ভব?’
খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘সাঈদী সাহেব ঘটনার সময় পিরোজপুরে ছিলেন না। তিনি যশোরেই ছিলেন। সাঈদী সাহেব একজন প্রফেশনাল বক্তা। তিনি সারা বছরই ওয়াজ-মাহফিল করেন। এটা করেই তিনি সংসার চালাতেন।’
ওই বক্তব্যের পর কিছু সময় ধরে খন্দকার মাহবুব তাঁর মক্কেল সাঈদীর রায় বিশ্লেষণমূলক বর্ণনা তুলে ধরেন।
ওই সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় যাঁরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সমর্থক ছিলেন, তাঁদের অনেকেই এখন মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির দায়িত্বে আছেন। ’
প্রধান বিচারপতি আরো বলেন, ‘আমরা সাক্ষ্য গ্রহণ আমলে নিয়ে এ মামলায় দ্বৈত আদেশ হয়েছিল। পরে আমরা সার্বিক বিচার বিশ্লেষণ করে ফাঁসির পরিবর্তে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছি। আমরা কিন্তু তাঁর দণ্ড কমিয়ে দিয়েছি।’
ওই সময় খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন,‘মাই লর্ড এ জন্য সাহস করে দাঁড়ালাম, অন্তত যাতে খালাস দেওয়া যায়।’ জবাবে প্রধান বিচারপতি বলেন,‘আপনি চাইতে পারেন।’
‘আমি আসামির ফাঁসি চাই’
খন্দকার মাহবুব হোসেনের বক্তব্যের পর রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি আসামি সাঈদীর সাজা বাড়িয়ে ফাঁসি চান।
অ্যাটর্নি জেনারেল শুনানিতে বলেন, ‘আসামিপক্ষ রিভিউতে আইনি বিষয়ে কোনো যুক্তি দিতে পারেনি, বরং তাঁরা শুধু বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরেছেন।’
জবাবে প্রধান বিচারপতি বলেন,‘আপনি তো একটি রায় পেয়েছেন। আপনি রিভিউর শুনানি করছেন কেন? আমরা চাই না বিচার বিভাগে প্রহসন হোক। রিভিউ করলে সাজা পরির্বতন কিন্তু রেয়ার।’
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন,‘আমি তো আসামির দণ্ড বৃদ্ধি করে ফাঁসি চাচ্ছি। কারণ এ মামলায় সাঈদী হুকুমের আসামি ছিলেন। অন্যদের ফাঁসি হলে হুকুমের আসামির ফাঁসি হবে না কেন? সাঈদী একজন কসাই ছিলেন যে মুক্তিযোদ্ধাদের দিনে-দুপরে হত্যা করতেন।’
জবাবে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনি কসাই বলবেন না। প্লিজ আপনি এভাবে বলবেন না। আপনি ফৌজদারি কার্যবিধি পড়ে আগামীকাল আসেন। আমরা আগামীকাল আবারও শুনব। এরপর আদালত মামলার কার্যক্রম আগামীকাল (সোমবার) পর্যন্ত মুলতবি করেন।’
রিভিউ আবেদনের এই শুনানি দুপুর ১২টা থেকে শুরু হয়ে ১টা ৫ মিনিট পর্যন্ত চলে।
প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগের বেঞ্চে ছিলেন বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন,বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার।
শুনানিতে সাঈদীর পক্ষে খন্দকার মাহবুব হোসেন ছাড়াও ছিলেন এস এম শাহজাহান ও তানভীর আল আমিন। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
মামলার সারসংক্ষেপ
২০১৬ সালের ১২ জানুয়ারি সাঈদীর সাজা আমৃত্যু কারাদণ্ড থেকে বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিভিউ আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। মোট ৩০ পৃষ্ঠার মূল আবেদনে পাঁচটি যুক্তি দেখানো হয়।
একই বছরের ১৭ জানুয়ারি আপিলের রায় থেকে খালাস চেয়ে রিভিউ আবেদন দায়ের করেন সাঈদী। মোট ৯০ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনে আমৃত্যু কারাদণ্ড থেকে খালাস পেতে ১৬টি যুক্তি দেখানো হয়েছে।
২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর সর্বোচ্চ আদালত সাঈদীর রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করেন। নিয়ম অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর ১৫ দিনের মধ্যে তা পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করতে পারে রাষ্ট্র বা আসামিপক্ষ।
২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড প্রদান করেন।