সরকার চাইলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সম্ভব : মাহবুব তালুকদার
আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা সম্ভব নয়। সরকার যদি সরকারি দলের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকে, তাহলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন না করলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন কমিশনের অডিটরিয়ামে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়। মাহবুব তালুকদারের বক্তব্যের বিষয়ে সভায় উপস্থিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা এনটিভি অনলাইনকে নিশ্চিত করেছেন।
সভা সূত্র জানায়, নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার তাঁর লিখিত বক্তব্যে বলেন, সরকার যদি সরকারি দলের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকে, তাহলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা সম্ভব। ইসির পক্ষে এককভাবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা সম্ভব নয়। তবু আমি মনে করি, সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে পুলিশের একটি বিরাট ভূমিকা আছে।
ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের নিয়ে পুলিশের তালিকা তৈরি সম্পর্কে এই কমিশনার বলেন, অতি উৎসাহী কিছু পুলিশ সদস্যের কর্মকাণ্ডে ব্যাপক বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচনী কর্মকর্তাদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে পুলিশ তথ্য সংগ্রহ করছে। এতে নির্বাচনী পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। এতে করে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এটা আমরা চাই না।
নির্বাচনী পরিস্থিতি বর্ণনা দিতে গিয়ে বিগত কয়েকটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের তথ্য চিত্র তুলে ধরেন সভায়। এ সময় মাহবুব তালকদার অভিযোগ করে বলেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ‘স্বরূপ সন্ধান’ শিরোনামে আমি একটি প্রতিবেদন তৈরি করে সিইসিকে দিয়েছিলাম। অজ্ঞাত কারণে সেটি এখনও আলোর মুখ দেখেনি।
মাহবুব তালুকদার তাঁর বক্তব্যে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের বিষয়ে তিনটি ঘটনার উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, প্রথম ঘটনা হচ্ছে, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ১৭৯ জনের একটি স্বাক্ষরবিহীন তালিকা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পাঠালে রিটার্নিং কর্মকর্তা তা গ্রহণে অসম্মতি জানান। পরে জেলা প্রশাসকের অফিস থেকে ফরোয়ার্ডিংসহ তালিকাটি পাঠানো হলেও তালিকায় কারো স্বাক্ষর ছিল না। এতে বলা হয়, গোয়েন্দা সংস্থা থেকে এ কার্যালয়ে একটি প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনটি গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নিয়োগ সংক্রান্ত। প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নিয়োগ সংক্রান্ত কার্যক্রম যেহেতু রিটার্নিং কর্মকর্তা কর্তৃক সম্পাদিত হয়ে থাকে, বিধায় প্রতিবেদনটি পরবর্তী প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে পাঠানো হয়।
মাহবুব তালুকদার বৈঠকে বলেন, স্বাক্ষরবিহীন ওই তালিকাটিতে কোনো শিরোনাম ছিল না। ফরোয়ার্ডিংয়ে জেলা প্রশাসক অফিসের নিম্নপর্যায়ের একজন কর্মকর্তার নাম ও স্বাক্ষর ছিল। আমি জানি না প্রিজাইডিং কর্মকর্তা নিয়োগে রিটার্নিং কর্মকর্তার কোনো অযাচিত সহায়তার প্রয়োজন আছে কি না।
দ্বিতীয় বিষয়টি সম্পর্কে মাহবুব তালুকদার বলেন, এটাও পুলিশের কার্যক্রম সম্পর্কিত। রিটার্নিং কর্মকর্তা মৌখিকভাবে বলেছেন। বিরোধী দলের মেয়রপ্রার্থীর কোনো অভিযোগপত্র পাঠানো হলে পুলিশ অফিস থেকে তা গ্রহণের স্বীকৃতিপত্র দেওয়া হতো না। অনেক অনুরোধের পর চিঠি গ্রহণ করা হতো। বিরোধী দলের মেয়রপ্রার্থীর পুলিশী হয়রানি, গণগ্রেপ্তার, ভীতি প্রদর্শন, কেন্দ্র দখল সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে পুলিশ নীরব ভূমিকা পালন করেছে। এসব অভিযোগ সংবলিত পত্রের কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। রিটার্নিং কর্মকর্তার পাঠানো ১১টি অভিযোগের মধ্যে মাত্র চারটির উত্তর পাওয়া গেছে, যা অনেকটা দায়সারা গোছের। পুলিশ বাকি সাতটি অভিযোগের কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি।
তৃতীয় বিষয়টিও পুলিশকে নিয়েই উল্লেখ করে এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘গাজীপুরে নির্বাচনকালে ইউনিফরমধারী পুলিশ ও সাদা পোশাকের পুলিশ অনেক ব্যক্তিকে বাসা থেকে কিংবা রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ আছে। অনেককে অন্য জেলায় নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের একজন ছাড়া পুলিশ অন্যদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে কোনো স্বীকারোক্তি দেয়নি। নির্বাচনের পরে দেখা যায়, তাদের অন্তত দশজনকে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে পাওয়া গেছে। গ্রেপ্তার না করলে তারা কারাগারে গেলেন কীভাবে? এ প্রশ্নের কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সম্পর্কে মাহবুব তালুকদার বলেন, এই সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের দায়িত্বে এককভাবে আমি ছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় পাঁচটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ছিল বরিশালের। সকালে ভোটগ্রহণ কার্যক্রম বেশ ভালো ছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানে বিভিন্নমুখী অনিয়ম শুরু হয়। বেলা ১১টার মধ্যে আমার কাছে প্রতীয়মান হয় যে, এভাবে ভোট গ্রহণ চলতে পারে না। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনারদের আমি জানাই বরিশালের ভোট কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া প্রয়োজন। একপর্যায়ে কমিশনারবৃন্দের সবাই ভোট বন্ধ করার বিষয়ে একমত হলেও নির্বাচন বন্ধ করলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে কিনা এবং নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হবে কি না ভেবে নির্বাচন বন্ধ করা থেকে আমরা বিরত থাকি। এরই মধ্যে ছয়জন মেয়রপ্রার্থীর মধ্যে পাঁচজন তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন এবং একজন প্রার্থীই প্রায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীনভাবে বিজয়ী হন।
মাহবুব তালুকদার বৈঠকে জানান, সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সবচেয়ে বড় ইতিবাচক দিক হলো এসব নির্বাচনে কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। বিভিন্ন স্থানে অনিয়ম সত্ত্বেও ভোটকেন্দ্রগুলোতে মোটামুটি শান্তি বজায় ছিল, শৃঙ্খলা কতটুকু বজায় ছিল তা প্রশ্নসাপেক্ষ। একই সময়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় নির্বাচনে ১৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। সেসব দিক বিবেচনায় সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ইতিবাচক বিষয়টি উপেক্ষা করা যায় না।
এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে যে পুলিশ গায়েবি মামলা করেছে, তফসিল ঘোষণার পরে তার পক্ষে রাতারাতি পাল্টে গিয়ে নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করা কতটুকু সম্ভব? এ প্রশ্ন মনে জাগে। পুলিশ বাহিনী নির্বাচনে সবচেয়ে বড় সহায়ক শক্তি। তারা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন না করলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে।
মাহবুব তালুকদার বলেন, কিছু সংখ্যক গায়েবি মামলার আসামিদের তালিকা বিরোধী দল থেকে নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয়েছে। যদিও অধিকাংশই পুরোনো মামলা। এসব মামলার অজ্ঞাতনামা আসামিদের অনেকের আদালত থেকে জামিন নেওয়া হয়তো সম্ভব হবে না। কোনো কোনো সম্ভাব্য প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা থাকার কারণে তারা নির্বাচনী প্রচারকাজ চালাতে ভয় পাচ্ছেন। এমন ভীতি সর্বক্ষেত্রে অমূলক নয়। নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাকে স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে নির্বাচন পূর্ব সময়ে প্রার্থীরা যাতে হয়রানির শিকার না হয়, সেজন্য ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এ সম্পর্কে নির্বাচন কমিশন থেকে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তা যথাযথভাবে পরিপালন করা প্রয়োজন।
ইসি মাহবুব বলেন, আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সম্প্রতি মিডিয়ায় যে বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে তা হলো নির্বাচন কর্মকর্তাদের তথ্য সংগ্রহে পুলিশ দুই মাস আগে থেকে মাঠে নেমেছে। তারা প্রিসাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং কর্মকর্তাদের বিষয়ে নানারূপ তথ্য সংগ্রহ করছে এবং জিজ্ঞাসাবাদ করছে। পত্রিকামতে এই তথ্যানুসন্ধানের বিষয়ে পুলিশকে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। কমিশন নির্বাচন কর্মকর্তাদের তথ্যসংগ্রহের জন্য কোনো নির্দেশনা দেয়নি। সুতরাং এসব কর্মকাণ্ড কে কী উদ্দেশ্যে করছে, তা রহস্যজনক। বলা বাহুল্য, অতি উৎসাহী কিছু পুলিশ সদস্যের এই কর্মকাণ্ডে ব্যাপক বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে, যার দায় নির্বাচন কমিশনের ওপর এসে পড়ে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে মাহবুব তালুকদার বলেন, আমি আগেও আপনাদের বলেছি সংবিধান অনুযায়ী দায়িত্ব পালনের জন্য আমরা যে শপথ গ্রহণ করেছি, আপনারা সেই শপথের অংশীদার। কারণ নির্বাচন আমরা করি না, নির্বাচন আপনারাই করে থাকেন। আপনারা আমাদের সবচেয়ে বড় সহায়ক শক্তি। অতীতে যে সব জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে আপনারা তাতে দক্ষতা নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছেন। আমি আশা করি অতীতের মতো আপনাদের সার্বিক সহযোগিতায় এবারও নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। তবু আমার বক্তব্যে আত্মবিশ্লেষণমূলক কথা বলতে হলো অধিকতর সচেতনতা সৃষ্টির জন্য।
সূত্র আরো জানায়, এবারের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নানা কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে কমিশনার মাহবুব বলেন, সত্যি বলতে কী, একাদশ জাতীয় নির্বাচন আমাদের আত্মসম্মান সমুন্নত রাখার নির্বাচন। আমরা কোনোভাবেই এই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ হতে দিতে পারি না। আর একথা সত্য যে আমরা প্রশ্নবিদ্ধ হলে তার দায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর বর্তাবে এবং আপনারা প্রশ্নবিদ্ধ হলে আমরা দায় এড়াতে পারব না। সুতরাং আশা করি জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা দেশবাসীর প্রত্যাশা পূরণ করতে পারব।