মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি : আবুল হায়াত ও রাইসুল ইসলাম আসাদ
চলছে স্বাধীনতার মাস। ১৯৭১ সালের এই মার্চেই দখলদার বাহিনীর সঙ্গে রক্তক্ষয়ী লড়াই শুরু করে এ দেশের মানুষ। শ্রমিক, কৃষক, চাকরিজীবী থেকে শুরু করে শিল্পীরাও ঝাঁপিয়ে পড়েন একাত্তরের সেই জনযুদ্ধে।
অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ নিজে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত অনেক চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করে মুগ্ধ করেছেন দর্শকদের।মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় দেশবরেণ্য অভিনেতা আবুল হায়াত হানাদার বাহিনীর হাতে আটক হয়েছেন বারবার। প্রতিবারই তিনি বেঁচে যান ভাগ্যগুণে। সেই সময়ের স্মৃতি নিয়েই এই দুই জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী কথা বলেছেন এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে।
আবুল হায়াত
অভিনেতা
৬৯, ৭০ সেই সময়টা ছিল উত্তাল। গোটা দেশে সাংস্কৃতিক আন্দোলন চলছিল। বাংলাদেশের ছাত্র ইউনিয়ন এটা করেছিল। সেই আন্দোলনের সঙ্গে আমি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত ছিলাম। পাকিস্তানি শাসকরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু আমরা সেই নিষেধ না মেনে হলে, মাঠেঘাটে, শহিদ মিনারে, ট্রাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিপ্লবী নাটক করেছি। ৭১ সালে ২৩ মার্চ বিপ্লবী নাটক ‘রক্ত দিলাম স্বাধীনতার জন্য’ হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ অসুস্থ হওয়াতে নাটকটিতে আর অভিনয় করতে পারিনি। আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ওই দিনে আমার বড় মেয়ে বিপাশার জন্ম হয়। একটু সুস্থ হওয়ার পর আমি পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামে যাই। মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত আমি অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়েই থাকি। শুধু এ কারণে মুক্তিযুদ্ধে আর অংশগ্রহণ করা হয়নি। তারপর জুন থেকে ডিসেম্বর আমি ঢাকাতেই ছিলাম। সেই সময় আর্মিদের সামনে অনেক বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছি। আমাকে অনেকবার লাইনে দাঁড় করানো হয়েছিল কিন্তু ভাগ্যক্রমে আমি বেঁচে যাই।
আর্মিরা একদিন আমার বাসায় এলো। আমাকে বলল- ‘তোমার কাছে বন্দুক আছে। আমাদের দিতে হবে।’ আমিও বন্দুকের কথা স্বীকার করে তাদের দিয়ে দিলাম। যদিও মার্চ মাসে সরকার সব বন্দুক জমা দেওয়ার কথা ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু আমি অসুস্থ থাকাতে জমা দিতে পারিনি। আমাদের বাড়িতে পুরুষ শুধু আমিই ছিলাম, তাই জমা দেওয়া কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু বন্দুক থাকার অপরাধে তারা আমাকে ধরে নিয়ে যায়। শেষ মুহূর্তে আমাকে তারা ছেড়ে দেয় একটা শর্তসাপেক্ষে।
শর্তটা ছিল আর্মি জেনারেলের কাছ থেকে লাইসেন্সের একটা সই আনতে হবে। আমাকে সাতদিনের সময় দেওয়া হয়। আমাকে বলেছিল তুমি মুক্তির লোক। যদি এটা না করো তাহলে তোমাকে মেরে ফেলা হবে।পরে আমার এক আত্মীয়র মাধ্যমে আমি বন্দুকের লাইসেন্সে সই করিয়ে আনি। আমার ভাগ্য ভালো শেষ পযর্ন্ত তারা আমাকে মারেনি।
এরপর ডিসেম্বরে আমার বাড়ির পাশে একটা বোমা ফাটে। আর্মিরা আমাকে ধরে নিয়ে যায়। আমাকে লাইনে দাঁড় করানো হয়। তারপর তারা আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি কি করি? বললাম ওয়াশার ইজ্ঞিনিয়ার। এটা শুনে তারা আমাকে ছেড়ে দেয়।
বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় আমরা আয়তুল কুরসি পড়ে বের হতাম। কারণ বের হলেই তারা আইডি কার্ড দেখতে চাইত, আরো নানা ধরনের প্রশ্ন করত। সবসময়ই আমরা ভয়ে থাকতাম। আমার মামা ও অনেক বন্ধুরা মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে শহীদ হয়েছেন।
বাংলাদেশে এখন কোনো পরিবার খুঁজে পাওয়া যাবে না যে তাদের আপন কেউ সেই সময় মারা যায়নি।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে সবাইকে অনেক বই পড়তে হবে। আমাদের মতো যাঁরা আছেন তাঁদের কাছ থেকে জানতে চাইলে অনেক তথ্য বেড়িয়ে আসবে।’
রাইসুল ইসলাম আসাদ
অভিনেতা
আমরা ভৌগোলিক স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু এখনো অনেক পথ বাকি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অনেকেই স্বাধীনতার মূল ইতিহাস উল্টে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। অনেকেই সঠিক কথা বলতে চায় না। রাজাকার, আলবদররা অর্থনৈতিকভাবে এখন শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তাই আমাদের এখন সচেতন হতে হবে। শুধু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র দেখে ইতিহাস খুঁজলে চলবে না। আমাদের দেশে আগে ১৭০০ সিনেমা হল ছিল এখন নেমে এসেছে সোয়া ৩০০তে।
যাইহোক, সঠিক ইতিহাস জানতে নিজের বুদ্ধি বিবেক দিয়ে অনুসন্ধান করতে হবে। এ প্রজন্ম গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি করেছে। এটা কেউ তাদের মাথায় বাড়ি দিয়ে শিখিয়ে দেয়নি। দেশ যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে এটা কারো দয়ার মাধ্যমে হয়নি। তাই সবকিছু মনিটরিং করতে হবে।
কিভাবে দেশ স্বাধীন হলো? কে করল? কারা করল? ৭ মার্চের ভাষণ কেন দেওয়া হয়েছিল? নিজের বোধ জ্ঞান দিয়ে সবকিছু বিবেচনা করতে হবে। এ দেশে এখন অস্থির অবস্থা চলছে। ধর্মকে অনেকেই ভালোবাসে না। সব ধর্মভীরুতা। বুঝে ধর্ম-কর্ম করতে হবে তো।