‘মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি’
‘বেলা ১২টা বাজতে তখন পাঁচ মিনিট বাকি। আমাদের টিম মিটিং শেষ হওয়ার পথে। বিকেলের ফাইনালকে সামনে রেখে মিটিং চলছিল। প্রজেক্টরে ম্যাচের পরিকল্পনাগুলো দেখাচ্ছিলাম মেয়েদের। হঠাৎ প্রজেক্টর বন্ধ হয়ে গেল। বিদ্যুৎও চলে গেল। ঠিক তখনই আটতলা বিল্ডিংয়ে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি টের পেলাম। ভয়ে অস্থির হয়ে পড়লাম সবাই। বাইরে তাকিয়ে দেখলাম সবকিছু উড়ছে, আর মানুষের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। আতঙ্ক আরো বেড়ে গেল। মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখছিলাম তখন।’ — মেয়েদের অনূর্ধ্ব-১৪ ফুটবল দলের কোচ গোলাম রাব্বানি ছোটন ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত নেপাল থেকে ফিরে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা এভাবেই বলছিলেন। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে করে রোববার রাতে দল নিয়ে ঢাকায় ফিরেছেন তিনি। কাঠমান্ডুর ৩৬ ঘণ্টার আতঙ্ক এখনো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাঁকে।
মেয়েদের এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিতে নেপালে গিয়েছিল বাংলাদেশ দল। ২৫ এপ্রিল ফাইনালে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল স্বাগতিক নেপাল। কিন্তু খেলা শুরু হওয়ার ঘণ্টা চারেক আগে ভূমিকম্পের তাণ্ডব শুরু হলে স্থগিত হয়ে যায় ম্যাচটি।
ভূমিকম্প শুরু হওয়ার সময় আটতলা ভবনের ছয়তলায় ছিল বাংলাদেশ দল। প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে ভবনটা নড়তে শুরু করলে খেলোয়াড়, কোচ, কর্মকর্তাসহ ২১ জনের দল দ্রুত নিচে নেমে পাশেই পাহাড়ের জুম খেতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেখানে গিয়ে আরেক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন ছোটন, ‘পাহাড় ফেটে কালো ধোঁয়া বের হতে দেখে মেয়েরা আরো আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ১০ মিনিট পর পাহাড় থেকে হোটেলে ফিরলেও তাদের আতঙ্ক কাটেনি। মেয়েরা ভীষণ কান্নাকাটি করছিল।’
হোটেলে ফেরার পর মেয়েরা আর রুমে যায়নি। সারা রাত হোটেলের লবিতেই কাটিয়ে দেয় তারা। সেই অভিজ্ঞতাও ভুলতে পারছেন না অনূর্ধ্ব-১৪ দলের কোচ ছোটন, ‘হোটেলের লবিতে হেঁটে, বসে আতঙ্কের মধ্যে কোনো রকমে কাটিয়ে দেই রাতটা। শুধু ভাবছিলাম কখন রাত শেষ হবে, কখন এয়ারপোর্টে যেতে পারব। এয়ারপোর্টে যাওয়ার সময় পড়লাম বিপাকে। ভাঙা রাস্তা ধরে চলাই কঠিন হয়ে পড়ছিল। কোনো রকমে এয়ারপোর্টে গিয়ে দেখি আরেক করুণ দৃশ্য। দেশে ফেরার আশায় বহু মানুষ রানওয়েতে বসে আছে।’
এমন দৃশ্য দেখে স্বাভাবিকভাবেই মন আরো খারাপ হয়ে যায় সবার। বাড়ি ফেরার দুশ্চিন্তাও বেড়ে যায় আরো। ছোটন জানালেন, ‘এয়ারপোর্টে গিয়ে যখন দেখলাম ভারতীয় দলের মেয়েরা বিশেষ বিমানে করে চলে যাচ্ছে আমাদের মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। এদিকে সন্ধ্যাও ঘনিয়ে আসছে। ৬টার দিকে শুনলাম বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ বিমান আসছে আমাদের নিয়ে যেতে। সাড়ে ৭টায় সেই বিমান এসে পৌঁছানোর পর কিছুটা স্বস্তি পেলাম। রাত ১১টায় বিমান থেকে নেমে ঢাকার মাটিতে পা রেখে কী যে ভালো লাগছিল, তা বলে বোঝাতে পারব না।’
দেশে ফিরে স্বস্তি পেলেও কাঠমান্ডুর আতঙ্ক এখনো ভুলতে পারছেন না ছোটন, ‘ভূমিকম্পের পর প্রায় ৩৬ ঘণ্টা নেপালে ছিলাম। শুধু মনে হচ্ছিল মানুষের মৃত্যু এত সহজ, এত কাছাকাছি হতে পারে! যেসব ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখেছি তা জীবনে ভুলতে পারব না।’