বাজেট
সামাজিক সুরক্ষা ও নারী উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ বাড়ছে
দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে এবারের বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা বলয়ের যৌক্তিক ও লক্ষ্যভিত্তিক সম্প্রসারণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০২১ সালের মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে শতকরা ৫০ ভাগ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নারী উন্নয়ন ও কর্মসুযোগ সংক্রান্ত প্রকল্পগুলো পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত।
আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট পেশ করার সময় এসব কথা জানান অর্থমন্ত্রী।
একই সাথে নারীর ক্ষমতায়ন এবং দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাঁদের অধিকতর সম্পৃক্ততাকে উৎসাহ দিতে নারী করদাতাদের করমুক্ত আয় সীমা দুই লাখ ৭৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে তিন লাখ টাকায় নির্ধারণ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।
এ ছাড়া আগামী অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়াতে বয়স্ক ভাতা ভোগীর সংখ্যা ২৭ লাখ ২৩ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৩০ লাখ জনে, বিধবা ও স্বামী নিগৃহিতা নারী ভাতাভোগীর সংখ্যা ১০ লাখ ১২ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১১ লাখ ১৩ হাজার জনে উন্নীত করা হবে বলে জানান অর্থমন্ত্রী। এ ছাড়া, দরিদ্র মায়েদের জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতাভোগীর সংখ্যা এবং কর্মজীবী দুগ্ধপ্রদানকারী মায়েদের সংখ্যা শতকরা ২০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হবে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশের সব উপজেলার ইউনিয়ন পর্যায়ের প্রতি ওয়ার্ডের সবচেয়ে বয়স্ক ১০ জন ব্যক্তি নিয়ম অনুযায়ী বয়স্ক ভাতা পেয়ে থাকেন। এদের মধ্যে নারী থাকেন অন্তত পাঁচজন। এরা প্রত্যেকে প্রতিমাসে ১৫০ টাকা করে বছরে এক হাজার ৮০০ টাকা ভাতা হিসেবে পান। সে হিসেবে এই অর্থবছরে এই খাতে সরকারকে আরো প্রায় ৪৯ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ দিতে হবে।
এ ছাড়া স্বামী মারা গেছেন বা অন্তত দুই বছর ধরে স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এমন নারীরাও মাসে ১৫০ টাকা করে বিধবা বা স্বামী নিগৃহীতা ভাতা পান। সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ায় এ বছরে এই খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে ১৮ কোটি টাকারও বেশি পরিমাণে। দরিদ্র গর্ভবতী মায়েদের জন্য প্রতিমাসে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৩৫০ টাকা করে ভাতা। বাজেটে এসব খাতে সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হলে সরকারের বরাদ্দও বাড়বে বেশ বড় আকারে।
নারী শ্রমিকদের আবাসন সুবিধা দিতে ঢাকার আশুলিয়ায় ৭৪৪ জনের বাসোপযোগী হোস্টেল নির্মাণ করার কথা জানান অর্থমন্ত্রী। বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে গ্রামাঞ্চলের দারিদ্র্যের হার কমাতে সুদমুক্ত ঋণদান কর্মসূচি পরিচালনার কথা তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী।
এ ছাড়া জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়াতে বাস্তবতায় উপযুক্ত নীতি-কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে নারীদের অংশগ্রহণ পুরুষের সমপর্যায়ে উন্নীত করার কথা বলেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে কর্মক্ষম নারীর ৩৩ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করছে। অন্যদিকে, সাম্প্রতিক সময়ে মোট শ্রমশক্তির বৃদ্ধির হারও কমেছে। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, বাল্যবিবাহ রোধ, নারী শিক্ষা, উপযুক্ত কর্মপরিবেশ সৃষ্টি, কর্মজীবী মহিলাদের জন্য আবাসন, শিশু-দিবাযত্ন-কেন্দ্র স্থাপন, যুব মহিলাদের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, চাকরিতে কোটা সংরক্ষণসহ নানা ধরনের নারীবান্ধব কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে চাই। আমি আশা করছি, শিক্ষাক্ষেত্রে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে অর্জিত লিঙ্গ সমতার কারণে ভবিষ্যতে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ অনেকখানি বাড়বে। বিদেশেও নারীর কর্মসংস্থান বাড়াতে সরকার সমভাবে সচেষ্ট। প্রতি মাসে ১০ হাজার গৃহকর্মী প্রেরণের বিষয়ে ইতিমধ্যে সৌদি সরকারের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী সৌদি সরকার এসব গৃহকর্মীকে সার্বক্ষণিক সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘দারিদ্র্য বিমোচনে আমরা অনেক অগ্রসর হয়েছি। তা সত্ত্বেও দেশের মোট জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। দেশকে পুরোপুরি দারিদ্র্যমুক্ত করতে আমরা সামাজিক সুরক্ষা বলয়ের যৌক্তিক ও লক্ষ্যভিত্তিক সম্প্রসারণ করছি। এ লক্ষ্যে প্রণয়ন করা হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র। উপরন্তু, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির কার্যকারিতা বৃদ্ধি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে শিগগিরই শুরু করতে যাচ্ছি ‘Strengthening Public Financial Management for Social Protection’ শীর্ষক প্রকল্পের বাস্তবায়ন। এর আওতায় আমরা অর্থ বিভাগে একটি Social Protection Unit প্রতিষ্ঠা করব।’
আবুল মাল আবদুল মুহিত আরো বলেন, ‘অসহায়-অবহেলিত-প্রতিবন্ধী নারীদের সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় আনা, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ, আত্মকর্মসংস্থানে ক্ষুদ্রঋণ ও দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা এবং জেন্ডার সংবেদনশীল আইনি কাঠামো, উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাজেট প্রণয়নের ফলে নারীরা ধীরে ধীরে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে উঠছেন। কর্মরত নারীর সংখ্যা ২০০৬ এর ১১ দশমিক ৩ মিলিয়ন হতে ২০১৩ সালে ১৬ দশমিক ৮ মিলিয়নে উন্নীত হয়েছে। নারী সমাজের শ্রম, মেধা ও মননকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। উল্লেখ্য, লিঙ্গ বৈষম্য হ্রাসে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়াতে বর্তমানে শীর্ষ অবস্থানে আছে। ‘The Global Gender Gap Report’ অনুসারে ২০১৪ সালে ১৪২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৬৮তম। শ্রীলঙ্কা, ভারত ও পাকিস্তানের অবস্থান বাংলাদেশের পেছনে। এ ছাড়া নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪২টি দেশের মধ্যে দশম। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীদের প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ সর্বক্ষেত্রেই লক্ষণীয়। দেশের প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার ও বিরোধী দলের নেতা সবাই নারী। তবে, একটি ক্ষেত্রে আমরা বেশ পশ্চাৎপদ। আমাদের মেয়েদের অনেকেরই বাল্য বয়সে বিয়ে হয়ে যায়, ১৮ বছরের আগেই তারা সংসারের দায়িত্ব গ্রহণ করে। অল্প বয়সে মাতৃত্ব নারী ও শিশুস্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর এবং এতে উচ্চশিক্ষায় নারীরা পিছিয়ে যায়। তাই বাল্যবিবাহ প্রশমনে আমাদের সামাজিক আন্দোলন জোরদার করতে হবে।’
নারীদের উন্নয়নে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ, ক্যাটারিং প্রশিক্ষণ, নারী আইসিটি ফ্রি-ল্যান্সারসহ বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন শুরু হতে যাচ্ছে বলে জানান অর্থমন্ত্রী। তিনি জানান, নারীদের অগ্রাধিকারভিত্তিতে কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বাজেটে নারীর হিস্যা তুলে ধরার জন্য ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে জেন্ডার বাজেট প্রকাশ করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।