জাবিতে ভিসি অপসারণ দাবিতে সংহতি সমাবেশ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) গতকাল মঙ্গলবার ঘোষিত হল খালি ও উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামের অপসারণের একদফা দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সংহতি সমাবেশ করেছে আন্দোলনরত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
আজ বুধবার বেলা ১১টার দিকে একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভবনের সামনে সংহতি সমাবেশে যোগ দেয়। সমাবেশে চলে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত। সমাবেশে বক্তব্য দেন ছাত্র ও শিক্ষকরা। বক্তব্যে সবাই উপাচার্যের অপসারণসহ শাস্তি দাবি করেন।
দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করছি। আন্দোলনকে ঠেকাতে যেসব ব্যবস্থা নিয়েছেন তা মূলত নিজেকে দুর্নীতি তদন্তের মুখোমুখি না করার লক্ষ্য। মিথ্যাবাদী কেউ ভিসি থাকতে পারেন না। কালকের শান্তিপূর্ণ অবস্থানের ওপর নারকীয় হামলাকে ‘গণঅভ্যুত্থান’ বলে জাতীর সামনে বিশ্ববিদ্যালয়কে লজ্জিত করেছেন। ভিসিকে শুধু অপসারণ নয়, শিক্ষক থেকেও অভ্যাহতি দেওয়ার জন্য আচার্য বরাবর আবেদন করব।’
অধ্যাপক ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমাদের সামনে থেকে ছাত্রদের চিলের মত ছোঁ দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। শুধু শিবির তকমা দিয়ে এ আন্দোলন ঠেকানো যাবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভিসিকে দ্রুত অপসারণের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়কে কলঙ্কমুক্ত করবেন।’
শিক্ষার্থী সাইমুম জানান, ‘ভিসির বাসার সামনে ভিসিপন্থী শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আমাদের সরাতে ব্যর্থ হয়। তারপরই ছাত্রলীগ গুণ্ডাবাহিনী হিন্দু শিক্ষার্থীদেরও বলছে তারা শিবির। তারা হিন্দুদের শিবির তকমা দিয়ে আন্দোলনকে দমাতে চান। আমরা চাই ভিসির পদত্যাগ।’
আরেক শিক্ষর্থী তাপস্বী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা গতকাল মেয়েদের একটি মিছিল নিয়ে মেয়েদের হলে প্রবেশ করি। হলে প্রাধাক্ষ্যরা তাদের তালাবন্দি করে রেখেছে। তারা বলেছে তাদের মুক্ত করে রেখেছে। একজন মেয়ে শিক্ষার্থীর পেটে লাথি দেওয়া হল। আর উপাচার্য বললেন অন্যকথা।’
সাবেক প্রক্টর ও রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক তপন কুমার সাহা জানান, ‘চার বছর প্রক্টর ছিলাম কোনো সময় ছাত্রলীগকে নামানোর প্রয়োজন মনে করিনি। গতকালকের ঘটনায় উপাচার্যকে শুধু পদত্যাগ করলে চলবে না, শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।’
অধ্যাপক ড. সৌদা আখতার, ‘গতকাল যখন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী দিয়ে শিক্ষক মেরেছে এটা খুবই মর্মাহত করেছে। জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েরা সব সময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। ভিসিকে অবশ্যই যেতে হবে এবং বিচারের আওয়াত নিয়ে আসতে হবে।’
শিক্ষার্থী সায়দা বলেন, ‘যে ভিসি ছাত্রীদের নিপীড়ন, ছাত্রদের রক্ত জড়িয়ে আনন্দে দিন কাটান তাহলে আপনি কিভাবে অভিভাবক হোন? আমরা এই উপাচার্যকে আর দেখতে চাই না।’
অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস বলেন, ‘ভয় দেখিয়ে, পুলিশ দিয়ে ন্যায্য আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না। মিথ্যাচার করে মসনদ টিকানো যাবে না। ভিন্ন মতকে জায়গা দিয়ে চান না বলেই ৩০ থেকে ৩৫ জন আন্দোলনকারীদের সহ্য করতে পারছেন না। তাইতো হামলা করে বন্ধ করতে চেয়েছেন। কিন্তু আজ সেই আন্দোলন জনতার আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। আমাদের আন্দোলনের ফসল হল তোমরা যারা আগামীর বাংলাদেশ।’
কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোজাম্মেল হক জানান, ‘আমি আজ এখানে এসেছি সংহতি জানাতে। আমিও আপনাদের সঙ্গে আছি। গতকালকের ঘটনায় আমি ব্যথিত ও মর্মাহত। সিন্ডিকেটে গতকাল হল খালি করার যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তার বিরোধিতা করছি।’
ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি অনিক রায় সংহতি জানিয়ে বলেন, ‘আপনাদের দাবি নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন চলছে। এই দাবি এখন সারা বাংলার ছাত্রসমাজের। আপনার গণঅভ্যুত্থানের বক্তব্যের পর সারা দেশে আপনার বিরুদ্ধে গণছাত্রঅভ্যুত্থান হয়েছে। এই আন্দোলন বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আপনাদের সঙ্গে থাকব।’
শিক্ষক সমিতির সদ্য পদত্যাগ করা সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক সোহেল রানা সংহিত জানিয়ে বলেন, ‘গতকালের ঘটনায় আমরা দেখেছি কীভাবে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করা হয়েছে। আমি ক্ষমাপ্রার্থী যে শিক্ষক সমিতির পদে থেকেও কিছু করতে পারিনি। তাই সেই দায় নিয়েই পদত্যাগ করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা সংকট চলছে। এই সংকট সমাধানে সরকারকে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক তানজিম উদ্দিন খান বলেন, ‘গতকালকে যে গণঅভ্যুত্থানের কথা বলা হয়েছে তা মূলত গণপশুত্বের অভ্যুত্থান। আমরা সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই পশুত্ব, স্বৈরাচারী আচরণ চিরতরে বিদায় করতে চাই। সংহতি জানাতে এসেছি কারণ অন্যায়ের প্রতিবাদ করা আমার নাগরিক অধিকার।’
আন্দোলনকর্মী রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, ‘যেসব দাগ আমাদের গায়ে ক্ষত হয়ে আছে উপাচার্য অপসারণের মাধ্যমে তা পূরণ হবে। উপাচার্য অপসারণের মাধ্যমে শুধু সমাপ্ত নয়, তাকে সর্বোচ্চ বিচারের সম্মুখীন করতে হবে। ছাত্রলীগের যেসব নেতা স্বীকার করেছেন তাদেরও বিচার করতে হবে। এই আন্দোলন উপাচার্য অপসারণ ও তার শাস্তি নিশ্চিত করা পর্যন্ত চলবে।’
সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি আশিকুর রহমান বলেন, ‘আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কোনো ষড়যন্ত্রকে প্রশ্রয় দেয়নি; দিবে না। আগামীর আন্দোলনে সবাইকে সোচ্চার থাকতে হবে।’
অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ বলেন, ‘যে সমস্যা সমাধানের জন্য হল বন্ধ করা হয়েছে সেটা কোনো সমাধান নয়। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করার মাধ্যমে উপাচার্য পূর্ণ নৈতিক অবস্থান হারিয়েছেন। সরকারি ছাত্র সংগঠনের দ্বারাই দুর্নীতির বিষয়টা প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু সরকার কোনো প্রদক্ষেপ নেয়নি। আজকের মধ্যেই আমরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত শুনতে চাই। বিকেলে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের একটি সমাধান চাই। যে সংগঠন বিশ্বজিৎ, আবরার, জুবায়েরকে হত্যা করেছে তার ওপর ভরসা করে আপনি টিকতে পারবেন না। আপনি মূলত গণঅভ্যুত্থানের ভয়েই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে রেখেছেন। গণঅভ্যত্থান হবে এবং তার ফলাফল হিসেবে আপনি অপসারিত হবেন। ভিসি নিজেই আন্দোলনকে ভিসিবিরোধী আন্দোলনে রূপ দিয়েছে। এই আন্দোলন জাহাঙ্গীরনগরের নয়, তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।’
আন্দোলনের সমন্বয়ক অধ্যাপক রায়হান রাইন, ‘গতকালের হামলার ঘটনা নজিরবিহীন। এই হামলা প্রথম শুরু করেন শিক্ষক-কর্মচারীরা। প্রক্টর, শিক্ষক সমিতির সভাপতি নিজে উপস্থিত থাকলেও তাঁরা নীরব ভূমিকা পালন করেছেন। ক্যাম্পাস যে নিরাপত্তার কথা বলে বন্ধ করা হয়েছে তার জন্য দায়ী এই প্রশাসন। এই উপাচার্য অপসারণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।’
অন্যদিকে প্রভোস্ট কমিটির মিটিংয়ে বিকেল সাড়ে ৩টায় মধ্যে ছাত্রছাত্রীদের হল ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।