জন্মদিন
আবাহনীর প্রাণপুরুষ শেখ কামাল
মুখে লম্বা দাড়ি, সাদা পাঞ্জাবি পরা এক ভদ্রলোক আবাহনী ক্লাবের বারান্দায় বসা খেলোয়াড়-কর্মকর্তাদের হাতে পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবার তুলে দিচ্ছেন। খাবার নিচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু এই প্রজন্মের অনেক খেলোয়াড়ই তাঁকে চিনতে পারছেন না। সেই ‘অচেনা’ লোকটি পুরনো ঢাকা নিবাসী মুজিবর রহমান। যদিও তাঁকে সবাই ‘পাগলা মুজিব’ নামেই চেনে। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের আবাহনী গ্যালারিতে এই নামেই পরিচিত ছিলেন তিনি। এখন আর তাঁকে স্টেডিয়ামে খুব একটা দেখা যায় না। তবে বছরের একটি দিন তিনি আবাহনী ক্লাবে আসবেনই। দিনটা ৫ আগস্ট, আবাহনী ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত শেখ কামালের জন্মদিন। প্রত্যেক বছর এই দিনে প্রিয় ক্লাবে আসার কথা ভুলেন না ‘পাগলা মুজিব’। তবে খালি হাতে নয়, ঝুড়ি ভরে পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী, মুখরোচক খাবার সঙ্গে নিয়ে আসেন আবাহনী-অন্তপ্রাণ মানুষটি। শেখ কামাল আর আবাহনীর প্রতি নিখাদ ভালোবাসাই ৫ আগস্ট ক্লাবে টেনে নিয়ে আসে তাঁকে। সবার হাতে খাবার তুলে দিতে-দিতে অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস পড়ে মুজিবর রহমানের। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নির্মমভাবে নিহত শেখ কামালের কথা তিনি কিছুতেই ভুলতে পারেন না।
এ দেশের বহু ক্রীড়াপ্রেমীর পক্ষেও শেখ কামালকে ভোলা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের আধুনিকতার পথে অগ্রযাত্রা যে তাঁর হাত ধরেই। শেখ কামালের হাতে গড়া আবাহনী ৪৩ বছর পেরিয়ে আজ এক বিশাল প্রতিষ্ঠান।
১৯৭২ সালে আবাহনী ক্রীড়া চক্রের যাত্রা শুরু হলেও তার প্রায় ছয় বছর আগে ক্লাবটির জন্ম। তখন অবশ্য আবাহনী ছিল ধানমণ্ডি অঞ্চলের একটি ছোট্ট ক্লাব। আবাহনী সমাজকল্যাণ সংঘ নামে পরিচিত সেই ক্লাব গড়ে উঠেছিল স্থানীয় কয়েকজন তরুণের উদ্যোগে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদেশে ১৯৬৯ সালে এই ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হন শেখ কামাল। ক্লাবের অন্য সদস্যদের চেয়ে বয়সে বেশ ছোট হলেও প্রথম দিনেই সবার মন জয় করে নেন তিনি। অসাধারণ নেতৃত্বগুণের কারণে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর হাতে চলে আসে পুরো ক্লাবের নেতৃত্ব।
বয়সে তরুণ হলেও তখনই শেখ কামাল একটি আধুনিক ক্লাব গড়ার স্বপ্ন দেখতেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে পাড়ার সেই ক্লাব থেকেই জন্ম হয় আবাহনী ক্রীড়া চক্রের। যাতে মূল ভূমিকা ছিল শেখ কামালের। গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে সেই সময়ই আবাহনীকে একটি আধুনিক ক্লাব হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন তিনি। তাই শুরুতেই নজর দেন জনপ্রিয় খেলা ফুটবলে। তখনকার তারকা ফুটবলারদের দলে টেনে চমকে দেন সবাইকে। কাজী সালাউদ্দিন, অমলেশ সেন, গোলাম সারোয়ার টিপুর মতো তারকাদের নিয়ে এসে আবাহনীর ফুটবল দল দারুণ শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তোলেন তিনি।
তবে শুধু তারকা ফুটবলারদের দলে টেনেই বসে থাকেননি শেখ কামাল। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে কীভাবে আধুনিকতা আনা যায় সেই চিন্তা সবসময় ঘুরতো তাঁর মাথায়। ফুটবলারদের জার্সি, বুট, খাবার থেকে শুরু করে আধুনিক কোচিংয়েরও ব্যবস্থা করেন তিনি। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের ফুটবল-ইতিহাসের একটি নতুন অধ্যায়ের জন্ম বঙ্গবন্ধু-তনয়ের হাত ধরে। আবাহনীতে একজন বিদেশি কোচ নিয়োগ দেন শেখ কামাল। স্কটিশ কোচ বিল হার্টের অধীনে সে বছর ঢাকার প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগে চ্যাম্পিয়ন হয় আবাহনী। দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ক্লাবটির সাফল্যের সূচনা তখন থেকেই।
জন্ম থেকেই আবাহনীর সঙ্গী হারুনুর রশিদ। ক্লাবটির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক তিনি। শেখ কামালের চেয়ে বয়সে কিছুটা বড় হলেও এক সঙ্গেই ছিল তাঁদের পথচলা।
আবাহনীর প্রাণপুরুষকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে হারুনুর রশিদ কিছুটা আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়লেন, ‘আবাহনী ক্লাব আর শেখ কামালকে কিছুতেই আলাদা করা যাবে না। এত অল্প বয়সে এমন সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। শুধু নেতৃত্বগুণ নয়, তাঁর আধুনিক চিন্তা-চেতনা আমাকে অবাক করে দিত। হয়তো বঙ্গবন্ধুর সন্তান বলেই এই গুণ ছিল তাঁর। মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেলেও দারুণ সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন শেখ কামাল। বেঁচে থাকলে হয়তো বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে অনেকদূর নিয়ে যেতে পারতেন।’
সেই সময়েই শেখ কামাল সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাসহ একটা আধুনিক ক্রীড়া কমপ্লেক্স গড়ার স্বপ্ন দেখতেন। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদই জানালেন সে কথা, “একদিন তিনি আলাপের ছলে বলেছিলেন, ‘সব আধুনিক সুবিধা থাকবে এমন একটা ক্রীড়া কমপ্লেক্স করলে কেমন হয়।’ সেই উদ্যোগও নিয়েছিলেন। বাস্তবায়ন হয়তো করে যেতে পারেননি, তবে আধুনিক চিন্তা-ভাবনার বীজ আমাদের মনে বপন করতে পেরেছিলেন। এটাই সবচেয়ে বড় কথা।’
আবাহনী ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা হলেও খেলোয়াড়-কোচ-কর্মকর্তা সবার সঙ্গেই শেখ কামালের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। সবার সঙ্গেই তিনি আন্তরিকভাবে মিশতেন। যে কারণে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সবার কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন।
খেলোয়াড়দের মধ্যে কাজী সালাউদ্দিনের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা বেশি ছিল। সেসব দিনের স্মৃতি আজও অম্লান বাংলাদেশের ফুটবল জগতের সবচেয়ে বড় তারকার মনে, ‘তাঁর চেয়ে বয়সে আমি কিছুটা ছোট ছিলাম। তবে তিনি এত আন্তরিকভাবে আমার সঙ্গে মিশতেন যে মাঝে-মধ্যে অবাক হয়ে যেতাম। কী বিশাল হৃদয় ছিল তাঁর! তিনি সবসময় মাঠে এসে আমাদের অনুশীলন দেখতেন, ভালো খেলার জন্য উৎসাহ দিতেন। এ ধরনের গুণ আমি খুব কম মানুষের মধ্যেই দেখেছি। তাঁর চিন্তা-ভাবনা ছিল অন্যদের চেয়ে একেবারে আলাদা। যে কারণে সেই সময় থেকেই আবাহনীতে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছিল।’
দক্ষ ক্রীড়া সংগঠক ছিলেন। নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতাও ছিল অতুলনীয়। তবে অমলেশ সেনের কাছে শেখ কামালের পরিচয় একটু আলাদা। অতীতে ফুটবলার আর বর্তমানে কোচ হিসেবে সুদীর্ঘ ৪৩ বছর ধরে আবাহনীর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অমলেশের কাছে তিনি ছিলেন বড় ভাইয়ের মতো, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় আমি কলকাতায় ছিলাম। বাংলাদেশ হানাদারমুক্ত হলেও মায়ের অসুস্থতার কারণে আমাকে বেশ কিছুদিন সেখানে থাকতে হয়েছিল। আমাকে নিয়ে আসার জন্য কলকাতায় তান্না ভাইকে (স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ম্যানেজার তানভীর মাজহার তান্না) পাঠিয়েছিলেন তিনি। প্রথম যেদিন ক্লাবে এসেছিলাম, সেদিন শেখ কামালের আন্তরিকতায় অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। একজন ভাইয়ের মমতায় আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন তিনি। তাঁর কাছ থেকে সেই ভালোবাসা সবসময় পেয়েছি।’
আধুনিক মন-মানসিকতা আর সবার প্রতি আন্তরিকতার জন্যই এই তিন বরেণ্য ফুটবল-ব্যক্তিত্বর জীবনে শেখ কামালের উজ্জ্বল উপস্থিতি। বুধবার দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে পাল্টে দেওয়া মানুষটির ৬৬তম জন্মদিন। জন্মদিন মানেই খুশির আমেজ। কিন্তু আবাহনী ক্লাবে চিত্রটা একেবারে আলাদা। আনন্দ নয়, সেখানে বিরাজ করছে শোকের পরিবেশ। অকালপ্রয়াত প্রতিষ্ঠাতার জন্মদিনে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছে আবাহনী। যে আলোচনা সভার প্রধান অতিথি শেখ কামালের বড় বোন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।