স্মরণ
সুলতানা কামাল—এক অনন্য অ্যাথলেট
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন সুলতানা কামাল। ছিলেন একজন কৃতী অ্যাথলেট। ষাটের দশক থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অ্যাথলেটিক ট্র্যাক দাপিয়ে বেরিয়েছেন তিনি। লং জাম্প ও ১০০ মিটার হার্ডলসে বরাবরই ছিলেন সেরা। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান গেমসে লং জাম্পে প্রথম হয়ে সবার দৃষ্টি কেড়েছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালের সহধর্মিণী সুলতানা আহমেদ খুকি (পরে সুলতানা কামাল) ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন। আজ তাঁর ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী।
ষাটের দশকের গোড়ার দিকে এ দেশের রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থায় মেয়েদের ঘরের বাইরে বেরোনোই কঠিন ছিল। সে সময় সুলতানা কামালের অ্যাথলেটিকসে যাত্রা শুরু। বর্তমান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে খুদে অ্যাথলেটদের দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে তাঁর অ্যাথলেটিকস-জীবনের সূচনা। ১৯৬২-৬৩ সালে আন্তবিদ্যালয় অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতা দিয়ে জড়িয়ে পড়েন নতুন জীবনে। তখন তিনি পড়তেন পুরান ঢাকার বকশীবাজার মুসলিম গার্লস স্কুলে। স্কুল অ্যাথলেটিকসে সবার দৃষ্টি কেড়ে পরে জাতীয় পর্যায়ে শুধু সুনামই কুড়াননি, তাঁর সৌজন্যে অ্যাথলেটিকস অঙ্গনেও প্রাণের সঞ্চার হয়েছিল।
তিনি লং জাম্পে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। স্বাধীনতার আগে পাকিস্তান আমলে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে যতবার তিনি এই ইভেন্টে অংশ নিয়েছিলেন, প্রতিবারই প্রথম হয়েছিলেন। পরে ১০০ মিটার হার্ডলসে অংশ নিয়েও সাফল্য পেয়েছিলেন বেশ কয়েকবার। ১৯৭৪ সালের জাতীয় অ্যাথলেটিকসে এই ইভেন্টে অবশ্য দ্বিতীয় হয়েছিলেন। সে সময় স্নাতক পরীক্ষা ছিল বলে নিয়মিত প্র্যাকটিস করতে পারেননি, তাই ফলও প্রত্যাশিত হয়নি। তবে ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে চট্টগ্রামে পরের আসরেই ১০০ মিটার হার্ডলসের স্বর্ণপদক নিজের করে নিয়েছিলেন তিনি।
সেবার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট শুধু ফিরেই পাননি, ১৭ দশমিক ৫ সেকেন্ড সময় নিয়ে জাতীয় রেকর্ডও গড়েছিলেন সুলতানা কামাল। তিনি যখন ফিনিশিং লাইন অতিক্রম করেন, তখন দ্বিতীয় হওয়া প্রতিযোগীরও দুটি হার্ডলস পার হওয়া বাকি ছিল। বাকিদের সঙ্গে এতটাই ব্যবধান ছিল তাঁর পারফরম্যান্সের।
সেটাই ছিল সুলতানা কামালের শেষ জাতীয় মিট। এর চার মাস পর না-ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি। এই কৃতী ক্রীড়াবিদের অকালমৃত্যুতে বাংলাদেশের অ্যাথলেটিকসের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী এবং সাবেক অ্যাথলেট ও সংগঠক হামিদা বেগম, ‘ইন্টার স্কুল প্রতিযোগিতায় খুকির (সুলতানা কমাল) সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। সেই থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে আমরা ঘনিষ্ঠতা ছিল। শুধু বান্ধবী বলেই বলছি না, তাঁর মতো বিশাল হৃদয়ের মানুষ এবং বড় মাপের অ্যাথলেট বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে আর আসেনি। মনে হয়, আর আসবেও না।’
খেলার মাঠে বা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সুলতানা কামালের মানবিক গুণাবলি সবাইকে মুগ্ধ করত। তিনি ছোটদের খুব স্নেহ করতেন আর বড়দের প্রতি ছিল তাঁর অসীম শ্রদ্ধা। তাই সবার প্রিয় মানুষ হয়ে উঠতেও সময় লাগত না।
প্রিয় বান্ধবীর স্মৃতি আজো অম্লান জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পাওয়া অ্যাথলেট হামিদা বেগমের হৃদয়ে, ‘একটা বিষয় আমাকে বেশ আকৃষ্ট করত, তাঁর মুখে লেগে থাকা হাসি। তাঁর হাসি খুব ভালো লাগত। সেই হাসি দেখে চোখ জুড়িয়ে যেত। দেখতে সুন্দর ছিল বলেই হয়তো তাঁর হাসি আমার এত ভালো লাগত। এই হাসি দিয়েই সে সবার মন জয় করে নিত। ওর মধ্যে কোনো অহংকার ছিল না। বঙ্গবন্ধুর পুত্রবধূ হওয়ার পরও তাঁর মধ্যে অহংকারের ছিটেফোঁটাও দেখিনি। এ কারণেই আর সবার চেয়ে সে আলাদা ছিল।’
সুলতানা কামালের আরেকটি অসাধারণ গুণের কথাও ভুলতে পারেন না হামিদা বেগম, ‘খেলার মাঠ বা রাজনীতি সব জায়গায় সে ছিল আমার প্রতিপক্ষ। কিন্তু প্রতিপক্ষসুলভ আচরণ তাঁর মধ্যে কখনোই দেখিনি। বড় হওয়ার জন্য কোনো অন্যায় প্রতিযোগিতা বা অনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার আশ্রয় নিত না সে। রাজনীতির কথাই ধরা যাক। সে ছাত্রলীগ করত আর আমি ছাত্র ইউনিয়ন। অথচ মিছিল-মিটিং শেষে আমরা একসঙ্গে বসে গল্প করতাম। শুধু আমার সঙ্গে নয়, সবার সঙ্গেই সুন্দর সম্পর্ক ছিল তাঁর।’
ছোট ভাই গোলাম আহমেদ টিটু সব সময় ছিলেন সুলতানা কামালের ছায়াসঙ্গী। প্রিয় বোনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ভারী হয়ে আসে তাঁর কণ্ঠ, ‘আমি খুবই ছোট ছিলাম তখন। মাঠে বেশির ভাগ সময় তাঁর সঙ্গেই থাকতাম। কাছ থেকে যতটা দেখেছিলাম তাতে বুঝতে পারি, তিনি খুবই উঁচু মাপের ক্রীড়াবিদ ছিলেন। আমাদের পরিবারের পূর্ণ সমর্থন পাওয়ায় তাঁর এগিয়ে যাওয়া সহজ হয়েছে। অবশ্য আমাদের পরিবারে খেলাধুলার অনুকূল পরিবেশ ছিল। মা-বাবা দুজনেরই খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ ছিল। যে কারণে আমার আপাও খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন।’
বয়সে অনেক ছোট হলেও রাজিয়া সুলতানা অনুকে খুবই স্নেহ করতেন সুলতানা কামাল। ‘খুকি আপা’র স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত এই অ্যাথলেটও আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়লেন, “১৯৭৩ সালে প্রথমবার জাতীয় মিটে অংশ নেওয়ার সময় তাঁকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। কথাবার্তা, আচার-আচরণ, পারফরম্যান্স সবকিছুতেই তিনি ছিলেন অনন্য। আমাকে তিনি আদর করে ডাকতেন ‘হরিণ’। তিনি বলতেন, আমার নাকি মাটিতে পা পড়ে না! শেষবার তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল পঁচাত্তরের ১৪ আগস্ট সকালে। খুব সুন্দর একটা শাড়ি পরে আমাদের প্র্যাকটিস দেখতে এসেছিলেন। সেই যে শেষ কথা হলো আর তো তাঁর দেখা পেলাম না!’
অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের বর্তমান যুগ্ম সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেনও খুব কাছ থেকে দেখেছেন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত সুলতানা কামালকে। তাঁর স্মৃতিতেও উজ্জ্বল এই অসাধারণ অ্যাথলেট, ‘১৯৭৫ সালের এপ্রিলে প্রথমবারের মতো জাতীয় মিটে অংশ নিয়েছিলাম। চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত সেই প্রতিযোগিতা চলার সময় একদিন হঠাৎ দেখলাম, দর্শক মাঠের একপাশে জড়ো হয়ে কাউকে যেন দেখছে। উৎসাহ নিয়ে আমিও গেলাম সেখানে। দেখলাম, হার্ডলসে অংশ নিতে যাওয়া সুলতানা কামালকে সবাই দেখছে। সেবারই তাঁকে প্রথম আর শেষবারের মতো দেখেছিলাম। তাঁর পারফরম্যান্সে মুগ্ধ হয়েছিলাম। আজো যেন তা চোখে ভাসে।’
নির্মমভাবে নিহত হওয়ার ৪০ বছর পরও এই অনন্য ক্রীড়াবিদকে নিয়ে এমন অজস্র স্মৃতি বহু মানুষকে আপ্লুত করে তোলে আজো। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, সুলতানা কামালের মতো গুণী অ্যাথলেটকে অকালেই হারাতে হয়েছে। এ ক্ষতি সত্যিই অপূরণীয়।