সাক্ষাৎকার
‘বাবার স্বপ্নপূরণ করে আজ আমি ক্রিকেটার’
বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল। সামনে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজে তাঁর ব্যক্তিগত পরিকল্পনা, দলের লক্ষ্য এবং ক্রিকেটে তাঁর উঠে আসার গল্প সবিস্তারে জানিয়েছেন এনটিভি অনলাইনকে।
প্রশ্ন : বেশ কয়েকদিনের ছুটি কাটিয়ে আবার প্র্যাকটিসে ফিরেছেন। কেমন অনুভূতি?
উত্তর : বিশ্বকাপের পর টানা তিনটি সিরিজ খেলেছি আমরা। তাই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজের আগে কিছুটা বিশ্রাম প্রয়োজন ছিল আমাদের। ১৮-১৯ দিন যে ছুটি পেয়েছিলাম, সবাই সবার পরিবারের সঙ্গে এই সময়টা কাটিয়েছি। কেউ দেশের বাইরে গিয়েছে, আমিও বিদেশে গিয়েছিলাম। ছুটি কাটিয়ে এসে খেলোয়াড়রা এখন নতুন উদ্যমে অনুশীলন শুরু করেছে। এটা আমাদের বেশ কাজে এসেছে।
প্রশ্ন : অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজকে সামনে রেখে বাংলাদেশের পরিকল্পনা কেমন?
উত্তর : আগামী তিন-চার সপ্তাহ আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে আমাদের ফিটনেসের যত উন্নতি হবে আগামী ছয় মাস তা আমাদের কাজে আসবে। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজেও আমাদের তা আরো বেশি কাজে আসবে।
প্রশ্ন : ফেভারিট অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দলের এবং আপনার ব্যক্তিগত লক্ষ্য কী হতে পারে?
উত্তর : অস্ট্রেলিয়া বিশ্বের অন্যতম সেরা দল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অস্ট্রেলিয়ার মতো দলের বিপক্ষে ভালো করতে হলে আমাদের সামর্থ্যের সেরাটা খেলতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে আমাকেও ভালো করতে হবে। আমার চেষ্টা থাকবে সিরিজ শুরুর আগে নিজেকে আরো ভালোভাবে তৈরি করে নেওয়া।
প্রশ্ন : অস্ট্রেলিয়ার এই দলে বিশ্বমানের তিন-চারজন বোলার আছে। একজন ব্যাটসম্যান হিসেবে তাদের মোকাবিলার পরিকল্পনা কেমন হতে পারে?
উত্তর : অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের মোকাবিলার জন্য আমাদের আলাদা কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে তাদের সতর্কভাবেই খেলতে হবে।
প্রশ্ন : মিচেল জনসনকে নিয়ে কি আলাদা করে পর্যালোচনা করেছেন?
উত্তর : এই মুহূর্তে অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম সফল বোলারদের একজন জনসন। এখন টিভি একটা বড় মাধ্যম, যেকোনো খেলোয়াড়কে ভালোভাবে চেনা-জানা যায়। আমি অ্যাশেজটা ভালো ফলো করেছি। জনসন কোন লেন্থে বল করে তা মনোযোগসহকারে দেখেছি। তবে তাঁর বিপক্ষে কেমন পারফর্ম করতে পারব মাঠেই তা ভালোভাবে বোঝা যাবে।
প্রশ্ন : অস্ট্রেলিয়ার দুর্দান্ত বোলিংয়ের বিপক্ষে আপনার ভালো করার সম্ভাবনা কতটুকু?
উত্তর : যদি সবকিছু ঠিকভাবে হয়, আশা করছি ভালো কিছু করতে পারব। আমার চেষ্টা আছে নিজের সামর্থ্যের সেরাটা দিয়ে খেলার।
প্রশ্ন : অস্ট্রেলিয়ার মিচেল জনসন ও দক্ষিণ আফ্রিকার ডেল স্টেইনদের মতো বোলারদের খেলাটা কি কঠিন?
উত্তর : আমি সেটা মনে করি না। তারাও বাজে বল দেয়। দেখেশুনে তাদের বাজে বলগুলো খেলতে পারলেই আমাদের পক্ষে ভালো কিছু করা সম্ভব।
প্রশ্ন : এমন কি হয়েছে কোনো বোলারকে খেলার আগে ভীতি কাজ করেছে?
উত্তর : পাকিস্তানের পেসার শোয়েব আক্তারের বিপক্ষে প্রথম খেলতে নেমে তা মনে হয়েছিল একবার। তাঁকে খেলার আগে ভয় নয়, কিছুটা নার্ভাসনেস কাজ করছিল। তবে একটা বল খেলার পর সেই নার্ভাসনেসটা কেটে গেছে। আসলে যখন ছোট ছিলাম তখন শোয়েব আক্তারের খেলা দেখেই বড় হয়েছি।
প্রশ্ন : মাঠে প্রতিপক্ষ বোলারদের ‘স্লেজিং’টাকে কীভাবে দেখেন?
উত্তর : কেউ যদি মাঠে আমাকে স্লেজিং করে, আমি এর জবাব মাঠেই দিয়ে দেই। বোলাররা স্লেজিং করলে কেউ হয়তো উত্তর দেয় না। কিন্তু আমি সে রকম নই, আমি জবাব দিতেই পছন্দ করি।
প্রশ্ন : ডেল স্টেইনের ৪০০তম উইকেটে আপনার ছবিই বারবার দেখানো হয়?
উত্তর : এটা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার আমার জন্য। কিন্তু আমি খুবই চেষ্টা করেছিলাম এ রকম আউট যেন না হই। তবে সত্য বাজেভাবেই আউট হয়েছিলাম আমি। তবে মাঠে যখন খেলতে যাই, তখন সে রকমভাবে ভেবে খেলা হয় না, এটি কোনো বোলারের ৪০০তম বা ৩৮০তম উইকেট হতে পারে।
প্রশ্ন : ২০০৭ সালের পর বাংলাদেশের ওপেনিংয়ে অনেক পরিবর্তন এসেছে। কার সঙ্গে খেলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন?
উত্তর : আমার কাছে মনে হয়, সবাই ভালো। আমি সবার সঙ্গেই ব্যাটিং করতে এনজয় করি। সৌম্য সরকার, ইমরুল কায়েস ও শামসুর রহমান শুভর সঙ্গে ব্যাটিং করতেও ভালো লাগে। আলাদা করে কেউ আমার পছন্দ নয়।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের বর্তমান দলটি সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?
উত্তর : ওয়ানডেতে আমরা অনেক উন্নতি করেছি। বেশকিছু অর্জনও আছে আমাদের। আমি মনে করি আমরা ভালোভাবেই এগোচ্ছি। তবে টেস্ট ক্রিকেটে আমাদের আরো অনেক কিছু শেখার বাকি আছে, আরো অনেক উন্নতি করতে হবে। সে হিসেবে টি-টোয়োন্টেতে আমাদের আরো বেশি উন্নতি করতে হবে। টেস্ট ক্রিকেটের চেয়েও বেশি।
প্রশ্ন : আগামী বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, বাংলাদেশ দল কতটুকু প্রস্তুত?
উত্তর : আসলে টি-টোয়েন্টি আমাদের খুব বেশি খেলা হয় না। গত এক বছরে আমরা মাত্র তিনটা টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছি। তিনটি ম্যাচই আন্তর্জাতিক। ঘরোয়া টি-টোয়েন্টে ম্যাচ খুব বেশি খেলা হয় না। এখন বিসিএলের মতো টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে যাচ্ছে বিসিবি। আমার মনে হয়, এটা আমাদের জন্য ভালো হবে।
প্রশ্ন : যখন রান পান না সবাই তিরস্কার করে, আবার রান পেলে প্রশংসা পান, আপনার বেলায় কেন হয় এমনটা?
উত্তর : আসলে আমি জানি না, কেন এমন হয়। আমি নিজেই এর উত্তর খুঁজছি।
প্রশ্ন : যতটুকু জেনেছি আপনি খুবই সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করেন। এটাই কি আপনার উন্নতির অন্যতম কারণ?
উত্তর : একজন খেলোয়াড়ের জন্য সুশৃঙ্খল জীবন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি চেষ্টা করি সুশৃঙ্খলভাবে চলতে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার চেষ্টা করি। যারা আমাকে জানে না তারা হয়তো আমাকে আগ্রাসী বলে থাকে।
প্রশ্ন : ১৯৯৭ সালে যখন বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, আপনার চাচার (আকরাম খান) নেতৃত্বেই এই সাফল্য পেয়েছিল বাংলাদেশ। তখন কি ভেবেছিলেন ক্রিকেটার হবেন?
উত্তর : আসলে তখনই স্বপ্নের বীজ বুনেছিলাম, ভবিষ্যতে একজন ক্রিকেটার হব। আইসিসি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর আমাদের বাসায় যে রং মাখামাখি হয়েছিল, তখনই আমার মনে হয়েছিল, আমি যদি আমার চাচার জায়গায় থাকতাম তাহলে আমাকে নিয়েও এমন হতো। সবচেয়ে বড় কথা, আমার বাবাব স্বপ্ন ছিল আমি একদিন ক্রিকেটার হব, তাঁর স্বপ্ন পূর্ণ করতেই আমি ক্রিকেটার হয়েছি। যা অর্জন করব তা আমার বাবার জন্য হবে।
প্রশ্ন : আপনি মেরে খেলতেই বেশি পছন্দ করেন। কেন?
উত্তর : আমার কাছে সব সময় মনে হয়, বল তো খেলার জন্যই। ঠেকিয়ে খেলব কেন? আসলে এটা আমার একেবারেই ব্যক্তিগত মত। আমি বরাবরই শুরুটা যেমন করি, শেষটাও সেভাবে খেলতে চাই।
প্রশ্ন : কোন কন্ডিশনে খেলতে আপনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন?
উত্তর : যে কন্ডিশনে বল ব্যাটে আসে, একটু বাউন্স থাকে, সেই কন্ডিশনে খেলতেই আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।
প্রশ্ন : কেউ কেউ বলেন, তামিম বোলারদের সম্মান করেন না, সব বলই মারতে চান। তা ঠিক?
উত্তর : একটা সময় এমন একটা ভাবনা আমার মধ্যে ছিল ঠিক। সব বলেই মারতে যেতাম। তবে বোলারদের সম্মান করি না তা ঠিক নয়। অবশ্যই বোলারদের সম্মান করি আমি। তবে এখন এই ক্ষেত্রে কিছু উন্নতি হয়েছে বলেই হয়তো আগের তুলনায় পারফরম্যান্স ভালো হচ্ছে।
প্রশ্ন : বাংলাদের ক্রিকেটকে ভবিষ্যতে কোথায় দেখতে চান?
উত্তর : আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ ওয়ানডেতে সেরা পাঁচ দলের মধ্যে থাকলে আমি অনেক গর্বিত হব। আর টেস্টে যদি আরো দুই ধাপ এগোতে পারি, তাহলে আরো ভালো লাগবে।
প্রশ্ন : আপনার মতোই বাঁহাতি ওপেনার শ্রীলঙ্কার কুমার সাঙ্গাকারা। তিনি ক্রিকেটকে বিদায় জানাচ্ছেন, তাঁর সম্পর্কে আপনি কী বলবেন?
উত্তর : তাঁর মতো একজন কিংবদন্তি ক্রিকেটার সম্পর্কে আমার বলার কিছু নেই। তা সাজেও না। তবে তাঁর সঙ্গে আমার বহুবার আলোচনা হয়েছে। অনেক স্মৃতি আছে। তাঁর জন্য আমার শুভকামনা রইল। আমরা সবাই তাঁর ব্যাটিং মিস করব।
প্রশ্ন : আপনাদের পরিবারের তিন প্রজন্ম ক্রিকেট খেলছে। আকরাম খান, নাফিস ইকবাল ও আপনি। তিনজনেরই বাংলাদেশের ক্রিকেটে অনেক অবদান। এটাকে কীভাবে দেখছেন?
উত্তর : আসলে আমার চাচা, আমার ভাই ও আমার মধ্যে ক্রিকেট নিয়ে খুবই কম আলোচনা হয়। মাঝেমাঝে হয়তো কথা হয়, কিন্তু তা খুব দীর্ঘ পরিসরে নয়। তবে পারিবারিকভাবে বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য আবদান রাখতে পারাটা আমাদের জন্য গর্বের।
প্রশ্ন : একদিন তো ক্রিকেটকে বিদায় জানাতেই হবে। যাঁরা তামিমের মতো হতে চান, তাঁদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
উত্তর : তাঁদের প্রতি আমার পরামর্শ, কোনো কিছুই খুব সহজে হওয়া যায় না। চেষ্টা থাকতে হবে, সাধনা করতে হবে। তাহলেই সাফল্য পাওয়া সম্ভব।