স্মরণ
শহীদ জুয়েল-এক মুক্তিযোদ্ধা ক্রিকেটার
তিনি ছিলেন আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান। ব্যাট হাতে মাঠে নামতেন ইনিংসের গোড়াপত্তন করতে। যোগ্যতা থাকলেও পাকিস্তান জাতীয় দলে খেলার সুযোগ ছিল না সেই সময়ের বাঙালি ক্রিকেটারদের। স্বাধীন বাংলাদেশের হয়ে টেস্ট খেলার স্বপ্ন ছিল তাঁর। তাই ব্যাট ছেড়ে অস্ত্র হাতে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আব্দুল হালিম চৌধুরী জুয়েল। দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু তাঁর সেই স্বপ্নপূরণ হয়নি। বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে ১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট গভীর রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন তিনি। আর ফিরে আসেননি এই মুক্তিযোদ্ধা ক্রিকেটার।
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র মতো বহু কালজয়ী গানের সুরস্রষ্টা আলতাফ মাহমুদ, আজাদ, বদি, রুমি, জুয়েলসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা তৎকালীন তেজগাঁওয়ে এমপি হোস্টেলের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে চিরদিনের মতো হারিয়ে যান। ধারণা করা হয়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কথিত সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার আগে ৪ সেপ্টেম্বের মধ্যে কোনো এক সময়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তাঁদের।
আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন ধ্বংসের অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন জুয়েল। পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে হাতের আঙুলে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা আহত জুয়েলকে আটক করে পাকিস্তানিরা। কোনো বাঙালির বিশ্বাসঘাতকতায় গভীর রাতে মগবাজারের রেলক্রসিং সংলগ্ন আজাদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের দল, মেজর খালেদ মোশাররফ ও ক্যাপ্টেন হায়দারের নেতৃত্বে গড়া দুই নম্বর সেক্টরের ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য ছিলেন জুয়েল। ক্র্যাক প্লাটুনের তথ্য ও সবার পরিচয় জানার জন্য অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয় তাঁর ওপর। যে হাত দিয়ে তিনি ব্যাট ধরতেন, সে হাতের দুটি আঙুল কেটে ফেলা হয়। তবে প্রচণ্ড নির্যাতন মুখ বুজে সয়ে একটা কথাও বলেননি তিনি।
বয়সে বড় হলেও সাবেক ক্রিকেটার ইব্রাহিম সাবেরের সঙ্গে বেশ সখ্যতা ছিল জুয়েলের। ক্লাব ক্রিকেটে একসঙ্গে আজাদ বয়েজের হয়ে খেলেছেন দুজনে। দীর্ঘ ৪৪ বছর পর এই মুত্যুঞ্জয়ী ক্রিকেটারের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আবেগে ধরে এল ইব্রাহিম সাবেরের কণ্ঠ, ‘জুয়েলকে ধরে নিয়ে যাওয়ার একদিন আগেও আমার সঙ্গে কথা হয়েছিল। বলেছিলাম সাবধানে থাকতে। হয়তো সাবধানেই ছিল সে, কিন্তু কোনো এক বাঙালির বিশ্বাসঘাতকতায় পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়ে যায়। তাকে ফিরে পাওয়ার অনেক আশা করেছিলাম। কিন্তু সেই আশা পূরণ হয়নি।’
একসঙ্গে খেলার অভিজ্ঞতায় খুব কাছ থেকে জুয়েলের ব্যাটিং-প্রতিভা দেখেছিলেন ইব্রাহিম সাবের। তিনি জানালেন, ‘জুয়েল খুবই প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান ছিল। ওপেনিংয়ে নামত, খুব আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করত। দক্ষ উইকেটকিপারও ছিল সে। বেঁচে থাকলে বাংলাদেশকে অনেক কিছু দিতে পারত।’
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে খেলতেন জুয়েল। তার আগে খেলেছিলেন আজাদ বয়েজের হয়ে। পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে কায়েদে আজম ট্রফিতেও খেলেছিলেন। পাকিস্তানের এই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় সাতটি ম্যাচ খেলেছিলেন তিনি।
১৯৫০ সালের ১৮ জানুয়ারি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে জন্ম নেওয়া জুয়েল ২৫ মার্চের কালরাতে মুক্তিকামী জনতার সঙ্গে রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়েছিলেন। মে মাসে ট্রেনিং নিতে ত্রিপুরার মেঘালয়ে চলে যান তিনি। এরপর যোগ দেন দুই নম্বর সেক্টরে। ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য গড়া হয় দুর্ধর্ষ ক্র্যাক প্লাটুন। সেই দলের গেরিলা ইউনিটের সদস্য ছিলেন তিনি।
১৯৭৩ সালে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে শহীদ জুয়েলকে মরণোত্তর বীরবিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে তাঁর নামে গ্যালারির একাংশের নামকরণও করা হয়েছে।