দেশের উপকার হলে যেকোনো মুহূর্তে পদত্যাগ করতে প্রস্তুত ইসি মাহবুব
নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মাহবুব তালুকদার বলেছেন, ‘বিশিষ্ট নাগরিকরা আমাদের কাছে পদত্যাগ দাবি করেছেন কি না, আমি জানি না। দাবি যদি করে থাকেন, তাহলে আমি ব্যক্তিগতভাবে পদত্যাগ করলে যদি লাভ হয়, দেশের যদি কোনো উপকার হয়; তাহলে আমি যেকোনো মুহূর্তে পদত্যাগ করতে প্রস্তুত।’
আজ সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন কমিশন ভবনের নিজ কার্যালয়ে ‘৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক আপনাদের পদত্যাগ দাবি করেছেন, এ ব্যাপারে আপনার অবস্থান কী’, এমন প্রশ্নে মাহবুব তালুকদার এ মন্তব্য করেন।
প্রশ্নের জবাবে মাহবুব তালুকদার আরো বলেন, ‘আর এই দাবিটা সম্ভবত আমাদের কাছে নয়, এটা অন্যত্র করা হয়েছে। আমরা তো একটি প্রসেসের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশনার হয়েছি। যদি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আমাদের ব্যাপারে গঠিত হয়, আমাদের কোনো বক্তব্য নাই। আর একটি প্রসেসের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত হওয়ার পরে পদত্যাগ করে ফেললাম, এটা কোনো বিষয় হয় না। আমি এ পর্যন্ত দু-তিনবার পদত্যাগের অনুরোধ পেয়েছি, এখন কতবার পদত্যাগ করব, সেটাও একটি প্রশ্ন।’
আপনি সব নির্বাচন নিয়ে আপনার ব্যক্তিগত অভিমত জানান। আপনার অভিমত কমিশন বরাবরই নিজস্ব বলে চালিয়ে দেয়। কমিশন সভায় আপনার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন অন্য কমিশনাররা। আপনি কমিশন সভায় নিজের ভূমিকা নিয়ে সন্তুষ্ট কি না, এমন প্রশ্নে মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘আমার কমিশন সভার ভূমিকা নিয়ে কোথায় আলোচনা হয়েছে, তা আমি অভিহিত না। আমার ভূমিকা ভালো ছিল, না খারাপ ছিল, কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে; আমি জানি না। আর চার বছর ধরে আমি যে বক্তব্য রেখে এসেছি, এটা অনেক সময়ই দেখা গেছে যে, অন্যদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কিংবা নির্দিষ্ট কাগজের পরিপ্রেক্ষিতে আমি ভিন্নমত পোষণ করি। এবং আমি বরাবরই বলি, ভিন্নমত যদি প্রকাশিত না হয়, তাহলে সেটা ভিন্নমত হতে পারে না। ভিন্নমতকে অবশ্যই প্রকাশিত হতে হবে।’
নতুন কমিশনার নিয়োগ আইন করার কোনো সুপারিশ করবেন কি না, এমন প্রশ্নে মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘এই সুপারিশ আমাদের ওপর নির্ভর করে না। এটা যাঁরা নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করেন বা তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকেন, তাঁরা এই সুপারিশ করতে পারেন।’
এই নির্বাচন কমিশনার তাঁর লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘বর্তমান নির্বাচন কমিশনের আজ চার বছর পূর্ণ হলো। পেছনের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, আমাদের আত্মবিশ্লেষণ প্রয়োজন। প্রায় সব নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলে আমরা তৃপ্তি বোধ করি। কিন্তু নির্বাচন বিষয়ে আমাদের সব দাবি জনগণের উপলব্ধির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কেবল রাজনৈতিক দল নয়, নীরব জনগোষ্ঠীর অশ্রুত ভাষা শ্রবণের প্রচেষ্টা থাকা প্রয়োজন।’
‘বর্তমানে নির্বাচন এককেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। এককেন্দ্রিক বহুদলীয় গণতন্ত্রের উপাদান হতে পারে না। যেহেতু নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না, সেহেতু নির্বাচনের প্রতিটি আইনকানুন ও আচরণবিধি কঠোরভাবে পালনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকে পরিপালন ও সংরক্ষণ করতে হয়। কিন্তু নির্বাচন প্রক্রিয়া যথাযোগ্য সংস্কার না করার কারণে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা এখন গভীর খাদের কিনারে। এই সংস্কার নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্ভর করে না। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলো এবং সংশ্লিষ্ট সকলের সমঝোতা প্রয়োজন।’ যোগ করেন মাহবুব তালুকদার।
মাহবুব তালুকদার আরও বলেন, ‘পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফল দেখে আমার ধারণা হচ্ছে, নির্বাচন নির্বাসনে যেতে চায়। নির্বাচন অর্থ অনেকের মধ্য থেকে ভোটের মাধ্যমে বাছাই। কিন্তু সে অবস্থা আজকাল পরিলক্ষিত হয় না। প্রশ্ন জাগে, নির্বাচন কি এখন পূর্বে নির্ধারিত? নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য না হলে, কোনো বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র আপন মহিমায় বিকশিত হতে পারে না।’
নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘আগামী মে মাস থেকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন দলীয় প্রতীকে ব্যাপক পরিসরে কয়েক ধাপে অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচনেও সহিংসতার আশঙ্কা করি। আচরণবিধি লঙ্ঘন ও হানাহানি বর্তমানে নির্বাচনের অনুষঙ্গ হয়ে গেছে। কোনো অনভিপ্রেত ঘটনাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। কারণ কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা মিলে একটি অবিচ্ছিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তাই প্রাণহানির অভিশাপ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রক্ষার পথ অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আমাদের উদ্যোগ কেন কার্যকর হচ্ছে না, তা খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ আবশ্যক।’
“বর্তমান নির্বাচন কমিশনের কার্যকালের শেষ বর্ষের প্রারম্ভে দাঁড়িয়ে একজন আশাবাদী মানুষ হিসেবে ‘যার শেষ ভালো তার সব ভালো’ এই প্রবাদবাক্যটিকে কি আশ্রয় করতে পারি?’ এমন প্রশ্ন রেখে মাহবুব তালুকদার তাঁর লিখিত বক্তব্য শেষ করেন।