রাজনীতি যুদ্ধাপরাধ মন্ত্রিত্ব ফাঁসি
মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যার অপরাধে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের। শনিবার দিবাগত রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে একযোগে দুজনের ফাঁসি কার্যকর করে কারা কর্তৃপক্ষ। দেশের ইতিহাসে এ প্রথম সাবেক দুই মন্ত্রীর ফাঁসি হলো।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে মুসলিম লীগ থেকে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর সামরিক শাসক এইচএম এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে এরশাদ সরকারের আমলে পরিবার পরিকল্পনা ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। ’৮৮ সালে জাতীয় পার্টি থেকে বেরিয়ে নিজেই দল গঠন করেন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি। পরে নিজের দল বিলুপ্ত করে ’৯৬ সালে যোগ দেন বিএনপিতে।
অপরদিকে, জামায়াতের সেক্রেটারি জোনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকারের সময় ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সমাজকল্যাণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনায় ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হয় তাকে।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী : প্রসিকিউশনের নথি থেকে জানা যায়, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রাজনীতির হাতেখড়ি মুসলিম লীগের মাধ্যমে। তাঁর বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরী ছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান মুসলিম লীগের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তিনি পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের স্পিকারও হয়েছিলেন।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর জন্ম চট্টগ্রামে, বেড়ে উঠেছেন সেখানেই। পড়াশোনা করেছেন চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে।
বাবার রাজনৈতিক আদর্শ অনুসরণ করে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীও রাজনীতি শুরু করেন মুসলিম লীগের মাধ্যমে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা হয়। ফজলুল কাদের চৌধুরী দালাল আইনে কারাগারে বন্দি অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। আর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ছিলেন পলাতক।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদে মুসলিম লীগ থেকেই প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর সামরিক শাসক এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে মন্ত্রীও হয়েছিলেন। ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টি থেকে বেরিয়ে নিজেই দল গঠন করেন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি। পরে নিজের দল বিলুপ্ত করে ১৯৯৬ সালে যোগ দেন বিএনপিতে।
২০০১ সালে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। নির্বাচনের পর বিএনপি ক্ষমতায় এলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা নিযুক্ত হয়েছিলেন। ওই সময়ে তিনি ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) মহাসচিব হিসেবে নির্বাচন করে হেরে যান।
বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বিভিন্ন দল থেকে এ পর্যন্ত মোট ছয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ
আইনজীবীদের মাধ্যমে জানা যায়, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের জন্ম ১৯৪৮ সালের ২ জানুয়ারি, ফরিদপুর জেলার পশ্চিম খাবাসপুরে। তাঁর বাবা মাওলানা আবদুল আলী জামায়াতে ইসলামীর মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়ে ১৯৬২-৬৪ সাল পর্যন্ত প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন।
আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ প্রথমে ফরিদপুর ময়জুদ্দিন স্কুলে ভর্তি হন এবং তারপর তিনি ফরিদপুর জিলা স্কুলে অধ্যয়ন করেন। মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা সম্পন্ন করার পর তিনি ফরিদপুরে রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন। রাজেন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং স্নাতক ডিগ্রি শেষ করার পর তিনি ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় আসেন।
১৯৭১ সালের জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি- মাত্র দুই-আড়াই মাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়াশোনা করেন। স্বাধীনতার পর তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।
ছাত্রসংঘে মুজাহিদ : উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র থাকাকালেই জামায়াতের তখনকার ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালে তিনি ফরিদপুর জেলা শাখার সভাপতি হন।
১৯৭০-এর ডিসেম্বরে ফরিদপুর ছাড়ার সময় তিনি জেলা ছাত্রসংঘের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। ঢাকায় এসে তিনি ইসলামী ছাত্রসংঘের ঢাকা জেলার সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। পরবর্তী সময়ে তিনি ১৯৭১ সালের জুলাইতে ছাত্রসংঘের প্রাদেশিক (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) সেক্রেটারি মনোনীত হন এবং এর মাত্র দুই মাস পর অক্টোবরে তিনি ছাত্রসংঘের প্রাদেশিক সভাপতি নির্বাচিত হন।
একাত্তরে ভূমিকা : ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার সংগ্রাম যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, সেই বছর জানুয়ারিতে ইসলামী ছাত্রসংঘের ঢাকা জেলা শাখার সভাপতি হন মুজাহিদ। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর জুলাই মাসে সংগঠনের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সেক্রেটারি এবং এরপর প্রাদেশিক সভাপতির দায়িত্ব পান।
মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গঠিত হলে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তার নেতৃত্ব দেন ইসলামী ছাত্রসংঘের তখনকার সভাপতি ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী। অক্টোবরে ওই বাহিনীর প্রধান হন মুজাহিদ।
তদন্ত সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, মুজাহিদের নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী যুদ্ধের মধ্যে ফরিদপুর, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা, অপহরণ, লুটপাটের মতো ব্যাপক মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালায়। এমনকি ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রস্তুতির সময়ও বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণ না করার সিদ্ধান্ত নেন মুজাহিদ।
জামায়াতের রাজনীতি : স্বাধীনতার পর মুজাহিদ জামায়াতের রাজনীতিতে যুক্ত হন। তিনি ১৯৮২-৮৯ পর্যন্ত ঢাকা মহানগর জামায়াতের আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ থেকে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালনের পর ২০০০ সালের ৮ ডিসেম্বর মুজাহিদ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মনোনীত হন এবং সেই থেকে তিনি এই দায়িত্বে।
কর্মজীবন : আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন নারায়ণগঞ্জ আদর্শ স্কুলের প্রধান হিসেবে। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত মুজাহিদ বাংলাদেশ পাবলিকেশন্স-এর চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। এ ছাড়া তিনি জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম-এর চেয়ারম্যান এবং সাপ্তাহিক সোনার বাংলার পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
পরিবার : মুজাহিদ ১৯৭৩ সালের ১৮ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করা বেগম তামান্না-ই-জাহানকে বিয়ে করেন। তিনি তিন ছেলে ও এক মেয়ের জনক।
২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার গঠনের পর জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়। নির্বাচনে না জিতলেও টেকনোক্র্যাট কোটায় তিনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। এর আগে মুজাহিদ তিনবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। কিন্তু কখনোই জয়লাভ করতে পারেননি।
বিচারের মুখোমুখি : বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর প্রথমে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদকে বিচারের আওতায় আনা হয়।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগের একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন মুজাহিদকে গ্রেপ্তার করার পর ২ আগস্ট তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
মামলার শুনানি শেষে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১২ সালের ২১ জুন ট্রাইব্যুনালে মুজাহিদের বিচার শুরু হয়। ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই মুজাহিদের বিরুদ্ধে আনীত রাষ্ট্রপক্ষের সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে ফাঁসির দণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ১১ আগস্ট আপিল করেন মুজাহিদ।
গত ১৬ জুন চূড়ান্ত রায়ে মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। আজ আইনি লড়াইয়ের শেষ ধাপ রিভিউ আবেদনের রায়েও মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত।